পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা কি সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে?


শিক্ষা মানুষের মেধা, চিন্তা, মনন ও সম্ভাবনার বিকাশের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু বর্তমান সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত একটি বড় প্রশ্ন হলো পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা কি সত্যিই শিক্ষার্থীর সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে? আমাদের দেশে যেমন, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও শিক্ষা মূল্যায়নের জন্য পরীক্ষা একটি প্রচলিত ও গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। তবে যখন এই পরীক্ষা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং জ্ঞান অর্জনের চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়াটাই প্রধান হয়ে যায়, তখন শিক্ষার্থীদের ভেতরে থাকা সৃজনশীলতার বিকাশ বড়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিক্ষা তো আসলে মানুষকে চিন্তাশীল, অনুসন্ধানী ও উদ্ভাবনী করে তোলার জন্য, কিন্তু পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা অনেক সময় সেই মৌলিক উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দেয়।

পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রধান মনোযোগ থাকে নির্দিষ্ট সিলেবাস বা বইয়ের ভেতরে সীমাবদ্ধ কিছু প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো করার দিকে। এর ফলে তারা শুধু কীভাবে ভালো নম্বর পাওয়া যায় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, কিন্তু কোনো বিষয়কে গভীরভাবে বোঝা, প্রশ্ন করা বা নতুনভাবে চিন্তা করার দিকে আগ্রহী হয় না। একজন শিক্ষার্থী যখন জানে যে তাকে শুধু নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রশ্ন মুখস্থ করতে হবে এবং পরীক্ষার হলে সেগুলো লিখতে পারলেই ভালো গ্রেড নিশ্চিত, তখন সে স্বাভাবিকভাবেই অনুসন্ধিৎসু মনোভাব হারিয়ে ফেলে। এভাবে বারবার একই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার চিন্তাশক্তি কেবল নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতরেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সৃজনশীলতা আসলে নতুনভাবে ভাবার নাম, যেখানে কল্পনা, বিশ্লেষণ, উদ্ভাবন ও সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা থাকে। একজন শিক্ষার্থী কোনো পাঠ্যবইয়ের বাইরে গিয়ে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে চাইলে, অথবা কোনো সমস্যার ভিন্নধর্মী সমাধান খুঁজতে চাইলে, সেখানে তার জন্য সুযোগ থাকা দরকার। কিন্তু পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা তাকে সেই স্বাধীনতা দেয় না। বরং অনেক সময় পরীক্ষায় নির্দিষ্ট উত্তর ছাড়া অন্যভাবে কিছু লিখলে নম্বর কেটে নেওয়া হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভিন্নমত প্রকাশ করতে ভয় পায়, এবং একসময় তারা কেবল একধরনের যান্ত্রিক লেখার অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর মাধ্যমে তাদের ভেতরে থাকা সৃজনশীল প্রতিভা চাপা পড়ে যায়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, এখানে অধিকাংশ স্কুল, কলেজ কিংবা মাদ্রাসায় পরীক্ষার ফলাফলকেই সবচেয়ে বড় মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষার্থী ভালো ফল করলে তাকে মেধাবী বলা হয়, আর যদি ফলাফল খারাপ হয়, তবে তাকে অযোগ্য বা অমনোযোগী বলে চিহ্নিত করা হয়। অথচ বাস্তবে একজন শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন কেবল পরীক্ষার ফলাফলের মাধ্যমে করা সম্ভব নয়। হতে পারে সে পরীক্ষায় খুব ভালো করতে পারেনি, কিন্তু অন্য কোনো ক্ষেত্রে যেমন সংগীত, সাহিত্য, প্রযুক্তি, ক্রীড়া কিংবা নেতৃত্ব প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তার অসাধারণ দক্ষতা রয়েছে। পরীক্ষার নম্বরকে একমাত্র মানদণ্ড বানানোর মাধ্যমে আমরা সেই গুণগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছি না, বরং উপেক্ষা করছি। এতে শিক্ষার্থীরা ধীরে ধীরে নিজেদের সীমাবদ্ধ মনে করতে শুরু করে এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের প্রেরণা হারিয়ে ফেলে। তাছাড়া পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি বড় সমস্যা হলো এর ফলে মুখস্থবিদ্যার প্রসার। শিক্ষার্থীরা বইয়ের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দেয়। তারা জানে, যতটা সম্ভব শব্দে-শব্দে বইয়ের ভাষা লিখতে পারলেই বেশি নম্বর পাওয়া যাবে। এর ফলে তাদের মধ্যে জ্ঞান অন্বেষণ বা বিশ্লেষণ করার প্রবণতা তৈরি হয় না। মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরশীলতা শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করে দেয়। পরবর্তী জীবনে যখন তাদেরকে বাস্তব কোনো সমস্যা সমাধান করতে হয়, তখন তারা সেই সমস্যাকে নতুনভাবে বিশ্লেষণ করার মানসিকতা নিয়ে এগোতে পারে না। তবে এ কথাও সত্য যে, পরীক্ষা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় নয়। শিক্ষার্থীদের শেখার অগ্রগতি যাচাই করার জন্য কিছু না কিছু মূল্যায়ন পদ্ধতি থাকা অবশ্যই দরকার। কিন্তু সেই মূল্যায়ন যদি কেবল লিখিত পরীক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা শিক্ষার সামগ্রিক উদ্দেশ্যকে বাধাগ্রস্ত করে। বরং যদি পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল কাজ, প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষা, উপস্থাপনা, দলগত আলোচনা, ব্যবহারিক কাজ ইত্যাদির মাধ্যমে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে তারা নিজেদের মেধা আরও ভালোভাবে প্রকাশ করার সুযোগ পাবে। বেশ কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যেই বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রচলন হয়েছে। যেমন ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থা পরীক্ষার চেয়ে শেখার প্রক্রিয়াকে বেশি গুরুত্ব দেয়। সেখানে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ধরণের সৃজনশীল কার্যক্রম, দলগত কাজ এবং ব্যবহারিক দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা করে না, বরং জ্ঞানকে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার দক্ষতাও অর্জন করে। আমাদের দেশেও যদি সেই ধরনের শিক্ষা সংস্কার আনা যায়, তবে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা শুধু সৃজনশীলতার বিকাশকে বাধা দেয় না, অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষার ফলাফলকেই জীবনের সাফল্য হিসেবে ধরে নেয়, তখন তারা অযথা চাপের মধ্যে পড়ে যায়। ভালো নম্বর না পেলে তারা হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে, অনেক সময় হতাশায় ডুবে যায়। এর ফলে আত্মহত্যার মতো ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। অথচ যদি শিক্ষাকে আমরা জীবনদক্ষতা অর্জনের একটি মাধ্যম হিসেবে দেখি, তাহলে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে অনেক বেশি সুস্থ ও আত্মবিশ্বাসী হতে পারবে।

শিক্ষার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা। পরীক্ষাকে একেবারেই বাদ দেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু পরীক্ষার ধরণ পরিবর্তন করা একান্ত প্রয়োজন। আমাদের প্রশ্নপত্র যদি এমনভাবে তৈরি হয় যাতে শিক্ষার্থীরা শুধু মুখস্থ না করে বরং নিজেদের যুক্তি, বিশ্লেষণ এবং সৃজনশীল চিন্তা প্রকাশ করতে পারে, তাহলে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হবে। এর জন্য শিক্ষকদেরও মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ভিন্নভাবে চিন্তা করতে উৎসাহিত করতে হবে, তাদেরকে প্রশ্ন করতে শেখাতে হবে। পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারেই সৃজনশীলতার বিকাশের অনুকূল নয়। এটি শিক্ষার্থীদের চিন্তাশক্তিকে যান্ত্রিক করে তোলে, মুখস্থবিদ্যার দিকে ঠেলে দেয় এবং আত্মবিশ্বাস নষ্ট করে। তবে বিকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতির প্রচলন, সৃজনশীল প্রশ্নের ব্যবহার এবং বাস্তবভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম বাড়ানো হলে এই সংকট অনেকাংশে সমাধান করা সম্ভব। শিক্ষা এমন হওয়া উচিত যা মানুষকে কেবল নম্বর পাওয়ার যন্ত্র বানায় না, বরং একজন চিন্তাশীল, সৃজনশীল এবং দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। তাই এখন সময় এসেছে পরীক্ষাকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে একটি সৃজনশীলতাভিত্তিক শিক্ষা সংস্কার বাস্তবায়নের।

 



Post a Comment

Previous Post Next Post