বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত মাধ্যমগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার কারণে এখন পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তথ্য পৌঁছাতে সময় লাগে না এক সেকেন্ডের বেশি। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার (এক্স), ইনস্টাগ্রাম, টেলিগ্রাম, কিংবা হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো শুধু বিনোদন বা যোগাযোগের জন্য নয়, বরং জ্ঞান ও শিক্ষার এক বিশাল ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যারা শিক্ষা অর্জনের পথে রয়েছে, তাদের উপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এই প্রভাবের দুটি দিক রয়েছেএকদিকে ইতিবাচক, যা শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করছে, অন্যদিকে নেতিবাচক, যা শিক্ষার্থীদের মনোযোগ, মানসিক স্বাস্থ্য ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
প্রথমেই বলা যায়, শিক্ষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষার্থীদের জন্য এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। অতীতে যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে জ্ঞানের জন্য সীমিত বই বা শিক্ষক নির্ভর থাকতে হতো, এখন সে পৃথিবীর যে কোনো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষক বা বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হতে পারে। ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মে লক্ষ লক্ষ শিক্ষা বিষয়ক ভিডিও পাওয়া যায়, যেখানে গণিত, বিজ্ঞান, ইসলামি শিক্ষা, প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা এমনকি রান্না শেখার মতো বিষয়ও শেখা সম্ভব। ফেসবুকে বিভিন্ন শিক্ষা ভিত্তিক গ্রুপে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যার সমাধান খুঁজে পায়, মেধাবী শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে এবং সমমনা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জ্ঞান ভাগাভাগি করতে পারে। অনলাইন ক্লাস এবং ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্মের ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মহামারির সময় পুরো বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা হয়ে দাঁড়ায় এই প্ল্যাটফর্মগুলো। শিক্ষকরা ফেসবুক লাইভ বা জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে ক্লাস নিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা ইউটিউব লেকচার দেখে শিখেছে, এবং টেলিগ্রাম কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ তৈরি করে পাঠ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে। ফলে শিক্ষা থেমে যায়নি, বরং ভিন্ন একটি রূপ নিয়েছে। এই অভিজ্ঞতা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বুঝিয়েছে যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবল বিনোদনের জন্য নয় বরং জ্ঞান বিনিময়ের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাবও কম নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো আসক্তি। একবার যখন শিক্ষার্থী বিনোদনের কনটেন্টে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন সে শিক্ষা বিষয়ক কনটেন্ট থেকে সরে গিয়ে বেশি সময় ব্যয় করে অপ্রয়োজনীয় ভিডিও, ছবি বা পোস্টে। ফেসবুক বা টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে অসংখ্য বিনোদনমূলক কনটেন্ট থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। তারা নির্ধারিত পড়ার সময় নষ্ট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়। এর ফলে তাদের একাডেমিক পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো তথ্যের সঠিকতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচুর তথ্য পাওয়া যায়, কিন্তু সব তথ্যই সঠিক নয়। শিক্ষার্থীরা অনেক সময় ভুয়া তথ্য, বিভ্রান্তিকর সংবাদ বা অযাচাইকৃত শিক্ষা কনটেন্টের শিকার হয়। ফলে তারা ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে তাদের শেখার প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু নির্ভুলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এ দিকটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ব্যবহার তাদের মস্তিষ্কে ডোপামিন নামক রাসায়নিকের অস্বাভাবিক নিঃসরণ ঘটায়, যা আসক্তি তৈরি করে। শিক্ষার্থীরা বাস্তব জীবনের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, ভার্চুয়াল দুনিয়াতেই বেশি সময় কাটাতে চায়। এ থেকে একাকীত্ব, হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দেয়। একইসঙ্গে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সাইবার বুলিং বা ট্রলিংয়ের শিকার হলে মানসিক চাপ আরও বেড়ে যায়, যা পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যদিও এ সব সমস্যার কথা বলা হচ্ছে, তবুও সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষায় এক বিপ্লব ঘটাতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বাংলাদেশের অনেক শিক্ষক এখন ইউটিউব চ্যানেল চালাচ্ছেন যেখানে তারা বিনামূল্যে শিক্ষা কনটেন্ট প্রদান করছেন। এতে করে গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরাও মানসম্মত শিক্ষা পাচ্ছে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রিসার্চ বা প্রজেক্টের কাজে বিশ্বখ্যাত গবেষক বা আন্তর্জাতিক জার্নালের সঙ্গে সংযুক্ত হতে পারছে। ফেসবুক বা টুইটারের মাধ্যমে তারা নতুন নতুন গবেষণা সম্পর্কে জানতে পারছে, যা আগে তাদের পক্ষে সহজ ছিল না।
শিক্ষকদের ভূমিকা এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সঠিকভাবে ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া। কিভাবে তথ্য যাচাই করতে হয়, কোন উৎসকে বিশ্বাস করা যায়, কত সময় পড়াশোনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করা উচিত এসব বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন। অভিভাবকদেরও ভূমিকা রয়েছে। তারা যদি সন্তানদের সময় নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং পড়াশোনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে উৎসাহিত করে, তবে শিক্ষার্থীরা আসক্তি এড়িয়ে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে যেতে পারবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম শিক্ষায় একদিকে আশীর্বাদ, অন্যদিকে অভিশাপ। এটি শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জন, গবেষণা ও বিশ্বসাথে যোগাযোগের নতুন দ্বার উন্মুক্ত করেছে। আবার একইসঙ্গে আসক্তি, ভুল তথ্য এবং মানসিক চাপের কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই আমাদের করণীয় হলো এ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করা। শিক্ষার্থীরা যদি সঠিক দিকনির্দেশনা মেনে চলে, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের শিক্ষাজীবনে উন্নতির সোপান হবে। অন্যথায় এটি তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে তুলবে। সর্বোপরি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে একটি শক্তিশালী শিক্ষা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে হলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি।
