হালাল ফুড ও সনদপ্রথা

বিশ্বব্যাপী মুসলিম জনগোষ্ঠীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যসংস্কৃতি হচ্ছে হালাল ফুড বা হালাল খাদ্য। হালাল শব্দটি আরবি, যার অর্থ বৈধ বা অনুমোদিত। ইসলামি শরীয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী, যা কিছু আল্লাহ ও রাসূল (সা.) বৈধ ঘোষণা করেছেন, তা-ই হালাল। খাদ্য, পানীয় ও ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই বৈধতা ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে সনদপ্রথা (Certification System) বা হালাল সার্টিফিকেশন হালাল খাদ্য পণ্যের নিরাপত্তা ও গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে একটি গুরুত্ববহ উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে যখন খাদ্যপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে অতিক্রম করে ভৌগোলিক সীমা, তখন হালাল সার্টিফিকেশন একটি মৌলিক চাহিদায় রূপ নিয়েছে।

হালাল খাদ্যের সংজ্ঞা ও পরিসর

হাদীস ও কুরআনের আলোকে হালাল খাদ্য বলতে বোঝানো হয় এমন খাদ্য যা ইসলামি শরীয়তের বিধান অনুযায়ী প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাত ও পরিবেশিত। কুরআনে বলা হয়েছে, হে মানবজাতি! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র, তা খাও (সূরা আল-বাকারা, ২:১৬৮)। এই হালাল ধারণা শুধুমাত্র খাবারের উপকরণ নয়, বরং তার সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বাজারজাতকরণ পদ্ধতির সাথেও সম্পর্কযুক্ত।

হালাল খাদ্যের অন্তর্গত উপাদানগুলো যেমন অ্যালকোহল, শূকরজাত দ্রব্য, মৃত পশু ইত্যাদি থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি, তেমনি প্রস্তুতির সময় ইসলামী রীতিনীতি অনুসরণ করাও আবশ্যিক। পশু জবাইয়ের ক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ আল্লাহু আকবার উচ্চারণ, ধারালো অস্ত্র ব্যবহার এবং সম্পূর্ণ রক্ত ঝরানোর মাধ্যমে জীবনহানি ঘটানো জরুরি। এছাড়া খাদ্যদ্রব্যে যদি এমন কোনো উপাদান থাকে যা সন্দেহজনক (মাশবুহ), তবে তা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ ইসলামে স্পষ্টভাবে দেয়া হয়েছে (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ১৫৯৯)।

হালাল সনদপ্রথার প্রয়োজনীয়তা

বর্তমান বিশ্বে, যেখানে বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে, সেখানে হালাল সার্টিফিকেশন একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে। এই সার্টিফিকেট মূলত এমন একটি ঘোষণা বা দলিল, যা পণ্যের হালাল বৈধতাকে প্রমাণ করে। এটি ইস্যু করে স্বীকৃত হালাল সার্টিফায়িং সংস্থা, যারা ইসলামী বিধান ও বিজ্ঞানভিত্তিক মান যাচাই করে হালাল ঘোষণা প্রদান করে।

হালাল সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে মুসলিম ভোক্তারা নিশ্চিন্তে পণ্য গ্রহণ করতে পারেন। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রেও তা প্রাসঙ্গিক। উদাহরণস্বরূপ, হালাল খাদ্যের প্রক্রিয়া অনেক সময় হাইজিনিক এবং স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে সম্পন্ন হয়, যার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি কমে যায়। তাই অনেক অমুসলিম দেশেও হালাল সার্টিফাইড পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।

আন্তর্জাতিক হালাল সার্টিফিকেশন সংস্থা

বিশ্বব্যাপী বেশ কিছু স্বীকৃত হালাল সার্টিফায়িং সংস্থা রয়েছে, যেমন, JAKIM (মালয়েশিয়া), MUI (ইন্দোনেশিয়া), HFA (যুক্তরাজ্য), IFANCA (যুক্তরাষ্ট্র), SANHA (দক্ষিণ আফ্রিকা) ইত্যাদি। এই সংস্থাগুলো নির্দিষ্ট গাইডলাইন অনুযায়ী পণ্যের উপাদান ও প্রক্রিয়া যাচাই করে হালাল সার্টিফিকেট প্রদান করে। জাতিসংঘের FAO এবং WHO এর সাথেও কিছু হালাল সংস্থা যৌথভাবে মানদণ্ড নির্ধারণে কাজ করছে।

এছাড়া International Halal Accreditation Forum (IHAF), Standards and Metrology Institute for Islamic Countries (SMIIC) এবং World Halal Council এর মত প্ল্যাটফর্মগুলো বিভিন্ন দেশের হালাল সনদ সংস্থার মধ্যে পারস্পরিক স্বীকৃতি এবং মান-একীকরণে ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশে হালাল সনদপ্রথা

বাংলাদেশে হালাল সার্টিফিকেশন ব্যবস্থা এখনো পরিপূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠিত না হলেও দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করছে। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (BSTI) হালাল মান নির্ধারণে কাজ করছে এবং কিছু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান যেমন, Islamic Foundation Bangladesh, Bangladesh Islamic Foundation for Halal Certification (BIFHC), Halal Bangladesh Services Ltd. (HBSL) সার্টিফিকেশন প্রদান করছে।

হালাল ফুড শিল্প বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। গার্মেন্টসের পর হালাল খাদ্য ও ওষুধ খাতেও বিশাল আন্তর্জাতিক বাজার ধরার সুযোগ রয়েছে, যদি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন হালাল সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া গড়ে তোলা যায়।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

হালাল সার্টিফিকেশনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো একক ও অভিন্ন মানদণ্ডের অভাব, অস্বীকৃত সংস্থার ভুয়া সার্টিফিকেট, এবং ভোক্তাদের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি। অনেক সময় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের আকৃষ্ট করতে মিথ্যা হালাল লেবেল ব্যবহার করে, যা ধর্মীয়ভাবে যেমন অসঙ্গত, তেমনি প্রতারণামূলকও।

এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন সরকারিভাবে স্বীকৃত হালাল সার্টিফিকেশন নীতিমালা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে হালাল সনদ প্রদানে রাষ্ট্র ও ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের যৌথ তত্ত্বাবধান জরুরি। পাশাপাশি, হালাল খাদ্য নিয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হালাল সচেতনতা কর্মসূচি চালু করা, এবং আন্তর্জাতিক মানে প্রশিক্ষিত পরিদর্শক তৈরি করাও গুরুত্বপূর্ণ।

উপসংহার

সার্বিক বিবেচনায়, হালাল ফুড ও সনদপ্রথা শুধুমাত্র ধর্মীয় বিধানের অংশ নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, নৈতিকতা এবং ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ। মুসলিম ভোক্তারা যখন হালাল খাদ্য নির্বাচন করেন, তারা কেবল ধর্মীয় দিক বিবেচনা করেন না, বরং নিরাপদ ও সুস্থ জীবনধারার জন্যও সচেতন থাকেন। তাই হালাল সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, আধুনিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলিম ভোক্তাদের আস্থা অর্জনের মাধ্যম হতে পারে।

 

তথ্যসূত্রঃ

  1. The Qur'an, Surah Al-Baqarah, 2:168
  2. Sahih Muslim, Hadith No. 1599
  3. World Halal Council https://www.worldhalalcouncil.com
  4. Bangladesh Standards and Testing Institution (BSTI) http://www.bsti.gov.bd
  5. Halal Bangladesh Services Ltd. https://halalbd.org
  6. JAKIM Malaysia https://www.halal.gov.my

 

Post a Comment

Previous Post Next Post