ভূমিকা
ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হলো আল্লাহর একত্বতা, যা তাওহীদ নামে পরিচিত। এটি একটি মৌলিক বিশ্বাস যা ইসলামের প্রতিটি দিককে প্রভাবিত করে। কুরআন ও হাদিসে আল্লাহর একত্বতা সম্পর্কে অসংখ্য দলিল পাওয়া যায়। নিন্মে আমরা কুরআন এবং হাদিসের আলোকে আল্লাহ তায়ালার একত্বতার বিভিন্ন প্রমাণ নিয়ে আলোচনা করব।
কুরআনে আল্লাহর একত্বতা
সূরা ইখলাস
"قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ"
অর্থ: "বল, তিনিই আল্লাহ, এক ও অদ্বিতীয়; আল্লাহ সর্বসমর্থ, তিনি জন্ম দেননি এবং জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।" (সূরা ইখলাস, ১১২: ১-৪)
সূরা ইখলাস আল্লাহর একত্বতা ও অদ্বিতীয়তা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানায়। এই সূরাটি সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত শক্তিশালী, যা আল্লাহর সত্তার সারমর্ম তুলে ধরে।
সূরা বাকারাহ
"اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّومُ ۚ"
অর্থ: "আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বকর্তা।" (সূরা বাকারাহ, ২: ২৫৫)
আয়াতুল কুরসী আল্লাহর একত্বতা এবং তাঁর সত্তার বিশালতা ও মহত্বের বিবরণ দেয়। এই আয়াতটি আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও জ্ঞানের প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত।
সূরা আলে ইমরান
"شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ ۚ لَا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ"
অর্থ: "আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। এবং ফেরেশতারা ও জ্ঞানীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি ন্যায় প্রতিষ্ঠাকারী। তিনি ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তিনি মহাপরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা আলে ইমরান, ৩: ১৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা নিজেই তাঁর একত্বতা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। এটি আল্লাহর একত্বতা এবং তাঁর মহত্বের একটি শক্তিশালী প্রমাণ।
সূরা নিসা
"إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا"
অর্থ: "নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁকে ক্ষমা করেন না, তাঁর সাথে কাউকে শরিক করা। তবে তিনি ক্ষমা করেন অন্য যাকে ইচ্ছা। এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করে, সে এক মহাপাপ করেছে।" (সূরা নিসা, ৪: ৪৮)
এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, শিরক (আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা) সবচেয়ে বড় পাপ এবং এটি ক্ষমার অযোগ্য। এটি আল্লাহর একত্বতার গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
সূরা মায়েদা
"قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ تَعَالَوْا إِلَىٰ كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلَّا نَعْبُدَ إِلَّا اللَّهَ وَلَا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلَا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِن دُونِ اللَّهِ ۚ فَإِن تَوَلَّوْا فَقُولُوا اشْهَدُوا بِأَنَّا مُسْلِمُونَ"
অর্থ: "বল, হে আহলে কিতাব! এমন কথার দিকে আস যা আমাদের এবং তোমাদের মধ্যে সমান; যে আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত করব না এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করব না এবং আমাদের কেউ কেউ অন্যকে রব হিসেবে গ্রহণ করবে না আল্লাহর পরিবর্তে। অতঃপর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, আমরা মুসলিম।" (সূরা মায়েদা, ৫: ৮২)
এই আয়াতে আহলে কিতাব (ইহুদি ও খ্রিস্টান) এর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যে তারা যেন আল্লাহর একত্বতা মেনে নেয়। এটি আল্লাহর একত্বতার সার্বজনীনতাকে তুলে ধরে।
হাদিসে আল্লাহর একত্বতা
হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
"মুয়াজ ইবন জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত: আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজের কথা বলুন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে রক্ষা করবে। তিনি বললেন: তুমি আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাস করো, এবং সেই অনুযায়ী আমল করো।" (সহিহ বুখারী, হাদিস নং: ১৩৩)
এই হাদিসে প্রমাণিত হয় যে তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাস ও আমল জান্নাতের পথে প্রেরণা যোগায়।
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত
"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যে ব্যক্তি হৃদয় থেকে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই) সাক্ষ্য দিবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।" (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ২৬)
এই হাদিসে সরাসরি আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাসের গুরুত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
ইবন উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত
"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ইসলাম পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত: (১) আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসুল; (২) নামাজ কায়েম করা; (৩) জাকাত প্রদান করা; (৪) রমজানের রোজা রাখা; (৫) যদি সক্ষম হও, হজ করা।" (সহিহ বুখারী, হাদিস নং: ৮)
এই হাদিসে ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে প্রথমটি হলো আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাস করা, যা ইসলামের মূল ভিত্তি।
মু'আধ ইবন জাবাল (রাঃ) হতে বর্ণিত
"রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে মু'আয! তুমি কি জান, আল্লাহর অধিকার তাঁর বান্দাদের উপর কি? এবং বান্দাদের অধিকার আল্লাহর উপর কি? আমি বললাম: আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সর্বাধিক অবগত। তিনি বললেন: আল্লাহর অধিকার বান্দাদের উপর হল, তারা তাঁকে এক ও অদ্বিতীয় হিসেবে বিশ্বাস করে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করে। আর বান্দাদের অধিকার আল্লাহর উপর হল, তিনি তাদেরকে শাস্তি দিবেন না যদি তারা তাঁর সাথে কাউকে শরিক না করে।" (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং: ৫০)
এই হাদিসে আল্লাহর একত্বতা সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা রয়েছে। বান্দাদের উপর আল্লাহর অধিকার এবং আল্লাহর উপর বান্দাদের অধিকার উভয়েরই গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
উপসংহার
কুরআন ও হাদিসের আলোকে আল্লাহ তায়ালার একত্বতা সম্পর্কে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি হল তাওহীদ বা আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাস। কুরআনের অসংখ্য আয়াত এবং হাদিসে আল্লাহর একত্বতা সম্পর্কে বিবৃত রয়েছে যা মুসলমানদের বিশ্বাসকে দৃঢ় করে। আল্লাহর একত্বতায় বিশ্বাস ও তার প্রতি আমল করাই প্রকৃত ঈমানের পরিচায়ক। আল্লাহর একত্বতার মর্মার্থ বুঝতে এবং তা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারাই হল প্রকৃত মুসলমানের পরিচয়।
