আল্লাহ তাআলার গুণাবলী সম্পর্কে মুতাজিলা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ বিশ্লেষণ

ইসলামী আকিদার (বিশ্বাসের) ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার গুণাবলী (صفات الله) সম্পর্কিত প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর আলোচনা ও বিশ্লেষণের বিষয়। এ বিষয়ে প্রধানত দুটি প্রধান ইসলামি চিন্তাধারা বিদ্যমান: মুতাজিলা এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। এই দুই ধারার মধ্যে আল্লাহর গুণাবলী (Attributes) ও তাঁর সত্তার (Essence) সম্পর্কের বিষয়ে মৌলিক মতপার্থক্য রয়েছে।

পটভূমি: গুণাবলী (صفات) ও সত্তা (ذات)

ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী, আল্লাহ তাআলা এক ও অদ্বিতীয়। তবে, আল্লাহর গুণাবলী মানে কি আল্লাহর সত্তার সাথে আলাদা কিছু? নাকি সেগুলো তাঁর সত্তার অংশ? এই প্রশ্নের উত্তরে মুতাজিলা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে, যা নিচে বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।

 

মুতাজিলা মতবাদ

মুতাজিলা ছিল একটি প্রাচীন যুক্তিনির্ভর ইসলামি তাত্ত্বিক আন্দোলন, যা ৮ম শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের প্রধান নীতি ছিল তাওহীদ (আল্লাহর একত্ব) এবং আদল (ন্যায়বিচার)। মুতাজিলা দর্শন মতে, আল্লাহর গুণাবলীর ধারণা এবং সেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তারা ভিন্নমত পোষণ করে।

১. আল্লাহর গুণাবলী ও তাওহীদ

  • মুতাজিলারা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর গুণাবলী (যেমন জ্ঞান, ক্ষমতা, ইচ্ছা) আল্লাহর সত্তার সাথে স্বতন্ত্র নয়। অর্থাৎ, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তার অংশ নয় বরং তাঁর কার্যাবলীর প্রকাশ।
  • তাদের মতে, যদি আল্লাহর গুণাবলীকে সত্তার থেকে আলাদা কিছু হিসেবে ধরা হয়, তবে তা বহুত্বের দিকে ইঙ্গিত করবে, যা তাওহীদের পরিপন্থী।
  • উদাহরণস্বরূপ, "আল্লাহ সর্বজ্ঞ" মানে আল্লাহর জ্ঞান আছে, তবে এই জ্ঞান আল্লাহর সত্তার থেকে আলাদা কিছু নয়।

২. গুণাবলীর বাস্তবতা ও সৃষ্টির ধারণা

  • মুতাজিলা মতে, আল্লাহর গুণাবলী আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়। এটি আল্লাহর কর্মের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
  • তাদের দৃষ্টিতে, গুণাবলীর বাস্তবতা মানলে তা আল্লাহর চিরন্তন সত্তার সাথে "অতিরিক্ত" কিছু হবে, যা শিরক বা বহুত্ববাদ সৃষ্টি করবে।
  • এই কারণে, মুতাজিলারা আল্লাহর গুণাবলীকে "মাজাযি" অর্থাৎ রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করে।

৩. কুরআনের ব্যাখ্যা

  • মুতাজিলা মতে, আল্লাহর গুণাবলী সম্পর্কিত আয়াতগুলো (যেমন, আল্লাহর হাত, চেহারা, ইত্যাদি) রূপক অর্থে বোঝা উচিত।
  • যেমন, "ইয়াদুল্লাহ" (আল্লাহর হাত) বলতে আল্লাহর শক্তি বা ক্ষমতা বোঝানো হয়েছে, আলাদা কোনো অঙ্গ নয়।

 মুতাজিলা বিশ্বাস করে আল্লাহ তাআলা সম্পূর্ণ একক, এবং তাঁর গুণাবলী আলাদা অস্তিত্ব নয় বরং তাঁর কর্মের ব্যাখ্যা। আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তার সাথে একীভূত এবং এগুলো আলাদা সত্তার মতো নয়।

 

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতবাদ

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, বিশেষত আশআরীমাতুরিদি আকিদা অনুসারীরা, আল্লাহর গুণাবলীকে বাস্তব এবং চিরন্তন মনে করে। তাদের মতে, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, কিন্তু তা আল্লাহর সত্তার থেকে আলাদা কোনো সত্তা নয়।

১. আল্লাহর গুণাবলী ও তাঁর সত্তা

  • আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, আল্লাহ তাআলার গুণাবলী (যেমন, আল-আলিম [সর্বজ্ঞ], আল-কাদির [সর্বশক্তিমান], আল-হায় [চিরঞ্জীব]) বাস্তব এবং চিরন্তন।
  • তাদের মতে, আল্লাহর গুণাবলী আল্লাহর সত্তার সাথে এমনভাবে সংযুক্ত যে, তা আল্লাহর সত্তা থেকে আলাদা কিছু নয়, তবে এগুলো আল্লাহর সত্তার অভ্যন্তরে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিদ্যমান।

২. কুরআন ও হাদিসের ভিত্তি

  • আহলে সুন্নাত অনুসারীরা কুরআন ও হাদিসের আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে, আল্লাহর গুণাবলীর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করা ইমানের অংশ।
  • যেমন, "আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা" (সূরা আশ-শূরা, আয়াত ১১) এই ধরনের আয়াতের দ্বারা আল্লাহর গুণাবলীর বাস্তবতা প্রতিফলিত হয়।
  • তারা বলে, আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে অযথা তর্ক না করে বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত।

৩. গুণাবলীর ধরণ

  • আহলে সুন্নাত মতে, আল্লাহর গুণাবলী সৃষ্ট নয়; বরং এগুলো চিরন্তন এবং আল্লাহর সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
  • তারা মনে করে যে, আল্লাহর গুণাবলী "বিলা কাইফ" অর্থাৎ কোনো রকম প্রশ্ন, ব্যাখ্যা বা তুলনা ছাড়াই বিশ্বাস করা উচিত।

 আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত বিশ্বাস করে, আল্লাহর গুণাবলী আসল এবং চিরন্তন। এগুলো আল্লাহর সত্তার সাথে যুক্ত, তবে আলাদা কোনো অস্তিত্ব নয়। তারা মনে করে যে আল্লাহর গুণাবলী মানলে তা তাওহীদের পরিপন্থী নয়।

 

তুলনামূলক বিশ্লেষণ

বিষয়ে পার্থক্য

মুতাজিলা

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত

গুণাবলীর অস্তিত্ব

আল্লাহর গুণাবলী আলাদা অস্তিত্ব নয়, সেগুলো রূপক

গুণাবলী বাস্তব এবং চিরন্তন

তাওহীদের ধারণা

গুণাবলীর স্বীকৃতি বহুত্বের দিকে ইঙ্গিত করে

গুণাবলীর স্বীকৃতি তাওহীদের পরিপন্থী নয়

শ্রুতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি

রূপক ব্যাখ্যা প্রাধান্য পায়

আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস স্থাপন

গুণাবলীর প্রকৃতি

আল্লাহর সত্তার সাথে অভিন্ন কিন্তু আলাদা নয়

সত্তার সাথে যুক্ত, কিন্তু সত্তা থেকে পৃথক নয়

 

আল্লাহ তাআলার গুণাবলী সম্পর্কে কুরআনের দলিল

আল্লাহ তাআলার গুণাবলী (صفات الله) সম্পর্কিত বিষয়টি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের অংশ। কুরআনে আল্লাহর বিভিন্ন গুণাবলী স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে আল্লাহ তাআলা গুণাবলী সহিত সত্তার অধিকারী। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আয়াত উল্লেখ করা হলো:

 

১. আল্লাহ সর্বজ্ঞ (العليم)

আয়াত:

"وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ"

"আর তিনি সবকিছুর সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন।"
(সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত ২৯)

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ সর্বজ্ঞ। তাঁর জ্ঞান সীমাহীন এবং তিনি সৃষ্টির সবকিছু সম্পর্কে অবগত।

 

২. আল্লাহ সর্বশক্তিমান (القادر)

আয়াত:

"إِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ"

"নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।"
(সূরা আল-বাকারা, আয়াত ২০)

এখানে আল্লাহর সর্বশক্তিমান হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে তাঁর ক্ষমতা অসীম।

 

৩. আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (السميع البصير)

আয়াত:

"إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ"

"নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।"
(সূরা আশ-শূরা, আয়াত ১১)

এখানে আল্লাহ তাআলার দুটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে: তিনি সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু দেখেন।

 

৪. আল্লাহর করুণাময় ও দয়ালু হওয়া (الرحمن الرحيم)

আয়াত:

"بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَـٰنِ الرَّحِيمِ"

"পরম করুণাময়, অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।"
(সূরা আল-ফাতিহা, আয়াত ১)

প্রায় প্রতিটি সূরার শুরুতেই আল্লাহর এই দুটি গুণাবলী উল্লেখ করা হয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে আল্লাহ দয়ালু এবং করুণাময়।

 

৫. আল্লাহর মহান শক্তি ও সৃষ্টিকর্তা হওয়া (الخالق)

আয়াত:

"اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ"

"আল্লাহ সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা।"
(সূরা আয-যুমার, আয়াত ৬২)

আল্লাহর সৃষ্টিকর্তা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যা তাঁর সৃজনশীল ক্ষমতার নির্দেশ করে।

 

৬. আল্লাহর হাত ও শক্তি সম্পর্কে (يد الله)

আয়াত:

"بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ"

"বরং তাঁর উভয় হাত প্রসারিত।"
(সূরা আল-মায়েদা, আয়াত ৬৪)

এই আয়াতে 'হাত' শব্দটি আল্লাহর শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

 

৭. আল্লাহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী (الملك)

আয়াত:

"تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاءُ"

"তুমি যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজত্ব ছিনিয়ে নাও।"
(সূরা আল ইমরান, আয়াত ২৬)

এখানে আল্লাহর ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে আল্লাহ সার্বভৌম।

 

 উপসংহার

আল্লাহর গুণাবলী নিয়ে মুতাজিলা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকলেও, আহলে সুন্নাতের দৃষ্টিভঙ্গিই আল্লাহর মহিমা ও পূর্ণতাকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করে। মুতাজিলারা আল্লাহর গুণাবলীকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করে এবং সেগুলোকে আল্লাহর সত্তা থেকে পৃথক কিছু হিসেবে না দেখার পক্ষে যুক্তি দেন, যাতে আল্লাহর একত্ব রক্ষা পায়। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহর প্রকৃত গুণাবলীর পূর্ণতার প্রতি সুবিচার করতে পারে না এবং আল্লাহর চিরস্থায়ী, অনন্য গুণাবলীর ধারণাকে সীমাবদ্ধ করে।


আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতে, আল্লাহর গুণাবলী তাঁর সত্তার সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত, যা চিরন্তন ও মহিমান্বিত। আল্লাহর জ্ঞান, দয়া, শক্তি, এবং ক্ষমার মতো গুণাবলী তাঁর সত্তার অপরিহার্য অংশ, যা তাঁর একত্বের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব তৈরি করে না। বরং, এই গুণাবলী আল্লাহর সত্তার মহিমা ও পরিপূর্ণতাকে প্রকাশ করে এবং মানবজাতির জন্য তাঁর ক্ষমা ও দয়ার নিদর্শন হিসেবে প্রতিফলিত হয়।


সুতরাং, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের দৃষ্টিভঙ্গি আল্লাহর পূর্ণতা ও একত্বের সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ এবং এটি আল্লাহর প্রকৃত মহিমা ও মহানুভবতাকে প্রতিফলিত করে। আল্লাহর গুণাবলীকে মেনে নেওয়া ও সম্মান করা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর প্রতি সঠিক ঈমানের পরিচায়ক এবং ইসলামের শিক্ষার সঠিক প্রতিফলন।

Post a Comment

Previous Post Next Post