গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ইসলামি পরিবেশনীতি

 


গ্লোবাল ওয়ার্মিং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুতর আলোচিত সমস্যা, যা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এটি মূলত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাস যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড প্রভৃতির অতিরিক্ত মাত্রায় বৃদ্ধির ফলে সূর্য থেকে আসা তাপ বিকিরণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে আটকে পড়ে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এই উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীতে বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, মৌসুমী পরিবর্তন ঘটছে, খরা-বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাড়ছে, যা মানবজীবনের জন্য মারাত্মক হুমকি। অথচ কুরআন হাদীসে আমরা প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ, মিতব্যয়িতা, অপচয়বিরোধী নীতিমালা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের স্পষ্ট নির্দেশনা পাই, যা অনুসরণ করলে এই দুর্যোগ থেকে অনেকাংশে মুক্ত থাকা যেত। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের আধ্যাত্মিক, সামাজিক পরিবেশগত চাহিদার পূর্ণ সমাধান দেয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষ সৃষ্টিজগতের প্রতিনিধি (খলীফা) এবং রক্ষণাবেক্ষণকারী। কুরআনে বলা হয়েছে, “তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি (খলীফা) করেছেন। (সূরা ফাতির: ৩৯) এই প্রতিনিধি হওয়ার অর্থ হলো মানুষকে শুধু নিজের স্বার্থে নয়, বরং সকল সৃষ্টির কল্যাণ বিবেচনায় নিয়ে জীবনযাপন করতে হবে। সুতরাং গাছপালা নিধন, নদী দুষণ, প্রাণীর উপর নিষ্ঠুরতা, মাটির উর্বরতা নষ্ট করা বা বায়ুতে দূষণ ঘটানো কোনোটিই ইসলামে অনুমোদিত নয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আধুনিক বিশ্বের শিল্পায়ন, অতিমাত্রায় প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার এবং মুনাফাকেন্দ্রিক অর্থনীতির ফলে আজ পৃথিবীর ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। ইসলাম আমাদের শেখায় মিতব্যয়িতা। কুরআনে বলা হয়েছে: তারা যখন ব্যয় করে তখন অপচয় করে না এবং কৃপণতাও করে না, বরং তাদের খরচ এই দুইয়ের মাঝামাঝি। (সূরা আল-ফুরকান: ৬৭) অথচ আধুনিক ভোগবাদী সমাজে পানির অপচয়, বিদ্যুৎ অপচয়, খাদ্য অপচয় একটি সাধারণ চিত্র। এগুলোর ফলেই অনিচ্ছাকৃতভাবে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেমন বিদ্যুতের অপব্যবহার বাড়লে তাপ উৎপাদনকারী জ্বালানি পুড়তে থাকে, যার ফলে বাতাসে কার্বন নির্গমন বেড়ে যায়। আবার খাবার নষ্ট করা মানে সেটা উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি, জমি, পরিবহন সবকিছুর অপচয়; যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের শিখিয়েছেন পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব কতখানি। তিনি বলেছেন: যদি কিয়ামত কায়েম হয়ে যায়, আর তোমাদের কারো হাতে যদি একটি খেজুর গাছের চারা থাকে, তাহলে সে যেন কিয়ামত হওয়ার আগেই তা রোপণ করে ফেলে। (সহীহ বোখারি) এই হাদীস আমাদের শিক্ষা দেয় পরিবেশ রক্ষা বৃক্ষরোপণ ইসলামে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। অন্যত্র তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে, সে যতদিন তার ফল থেকে উপকৃত হয় ততদিন তা তার জন্য সদকাহ হিসেবে গণ্য হয়। (সহীহ মুসলিম) তাহলে প্রশ্ন জাগে আজকের দিনে আমাদের গাছ কেটে শিল্প স্থাপন, পাহাড় কেটে নগরায়ন এবং বনভূমি উজাড় করার যৌক্তিকতা কোথায়?

ইসলামে পানি সংরক্ষণের উপরেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাদীসে বর্ণিত আছে রাসূল (সা.) অতি সামান্য পানি ব্যবহার করে ওযু করতেন এবং সাহাবাদেরকেও কম পানিতে ওযু গোসল করার নির্দেশ দিতেন। এমনকি একবার তিনি এক সাহাবীকে অতিরিক্ত পানি ব্যবহারে ভর্ৎসনা করেছিলেন, বলেছিলেন: এই পানির অপচয় কেন?” সাহাবী বললেন, “আমি কি পানি অপচয় করছি ওযু করার সময়েও?” তিনি বললেন, “হ্যাঁ, তুমি যদি একটি প্রবাহমান নদীর পাশেও থাকো, তবুও পানি অপচয় করা যাবে না। (ইবনে মাজাহ) হাদীসগুলোর মাধ্যমে বোঝা যায়, পানির যথাযথ ব্যবহার সংরক্ষণ একটি ইসলামি দায়িত্ব। অথচ বর্তমানে গৃহস্থালি, কৃষি শিল্পে পানির অকার্যকর অপরিকল্পিত ব্যবহার গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ দূষণের আরেকটি বড় কারণ হলো প্লাস্টিক রাসায়নিক বর্জ্য। এই বর্জ্যগুলো জমি, পানি বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে। ইসলাম পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টকারী এমন কাজকে নিরুৎসাহিত করেছে। রাসূল (সা.) বলেছেন: পথঘাটে মানুষের চলাচলের জায়গায় ছায়ার নিচে পায়খানা করো না। (মুসলিম) এই হাদীস পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা জনস্বাস্থ্য রক্ষার স্পষ্ট শিক্ষা দেয়। অথচ আজকের সমাজে অপরিষ্কার শহর, রাস্তার ধারে ময়লার স্তূপ, খোলা নর্দমা শিল্পবর্জ্যের অনিয়ন্ত্রিত নিষ্কাশন আমাদের দৈনন্দিন দৃশ্য। এগুলো শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, বরং পরিবেশগত বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও বহন করে।

গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের আরেকটি মারাত্মক ফল হচ্ছে প্রাণিকুলের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়া। নানা গবেষণায় দেখা গেছে অত্যধিক উত্তাপ, বনভূমির ধ্বংস এবং খাদ্য শৃঙ্খলার বিঘ্নের কারণে অনেক প্রাণী বিলুপ্তির পথে। অথচ কুরআনে বলা হয়েছে: পৃথিবীর উপরে যত জীব আছে, সবই একটি জাতি। (সূরা আন-আম: ৩৮) আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায় প্রতিটি প্রাণীর বেঁচে থাকার অধিকার আছে এবং মানুষকে সেই অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হতে হবে। নবী করীম (সা.) কেবল মানবজাতির কল্যাণের কথাই বলেননি; বরং পশুপাখির প্রতি সদয়তা, তাদের নিরাপত্তা এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার উপরেও গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি একটি চড়ুই পাখিকেও অন্যায়ভাবে হত্যা করে, আল্লাহ তার জবাবদিহি নেবেন। (আন-নাসাঈ) তাহলে আজকের দিনে পরিবেশদূষণের মাধ্যমে এই নিরীহ প্রাণিকুল ধ্বংস করার পেছনে আমাদের কি জবাবদিহি নেই? আধুনিক কালে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনেক মুসলিম দেশেই দেখা দিচ্ছে খরা, অতিবৃষ্টি, বন্যা, কৃষিক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি এবং খাদ্য সংকট। ইসলাম মানুষকে শুধু ইবাদতের দিকেই আহ্বান করেনি; বরং শস্য উৎপাদন, পানি ব্যবস্থাপনা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, পরিবেশ রক্ষা এসবকেও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যদি তা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হয়। তাই ইসলামি সমাজব্যবস্থায় পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়, বরং প্রতিটি ব্যক্তিরও। কুরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে: মানুষের কৃতকর্মের ফলে স্থলে জলে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যেন তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে। (সূরা আর-রূম: ৪১) এই আয়াতটি গ্লোবাল ওয়ার্মিং পরিবেশ বিপর্যয়ের পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বলে মনে হয়। আল্লাহর সৃষ্ট সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ পৃথিবী মানুষ নিজেই নিজের হাতে ধ্বংস করে চলেছে। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের ফল এখন পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলেই স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। তাই ইসলামি পরিবেশনীতি অনুসরণ করলেই গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ক্ষতিকর প্রভাব হ্রাস করা সম্ভব। এর জন্য দরকার ব্যক্তি, পরিবার রাষ্ট্র পর্যায়ে সচেতনতা বাস্তব পদক্ষেপ। ইসলাম আমাদেরকে শেখায় সংযম, শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ, অপচয়বিরোধিতা সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ। এগুলো শুধুমাত্র নৈতিক শিক্ষা নয়, বরং পরিবেশ রক্ষার শক্তিশালী হাতিয়ারও বটে। ইসলামি সমাজে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য হতে পারে কিছু বাস্তবিক করণীয় () বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ, () পানি বিদ্যুৎ ব্যবহারে মিতব্যয়িতা, () গাড়ির ধোঁয়া কারখানার বর্জ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারী ব্যবস্থা, () প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যবহার, () শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মসজিদে পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক আলোচনা। তাছাড়া ইমাম খতিবগণ তাদের জুমার খুতবায় বিষয়গুলো তুলে ধরতে পারেন, কারণ ইসলামের ভাষায় বললে মুসলমানেরা তা বেশি মনোযোগের সঙ্গে গ্রহণ করেন।

গ্লোবাল ওয়ার্মিং এখন শুধু বৈজ্ঞানিক নয়, বরং নৈতিক এবং ধর্মীয় ইস্যুও বটে। ইসলাম শুধু আখিরাত নয়, দুনিয়াকেও নিরাপদ রাখার ধর্ম। তাই ইসলামের পরিবেশনীতি অনুসরণ করলে একদিকে যেমন আল্লাহর নির্দেশ পালন হবে, অন্যদিকে পৃথিবীও হবে বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ। আমরা যদি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অনুযায়ী প্রকৃতিকে ভালোবাসি, তার সাথে সহাবস্থান করি এবং পরিবেশ রক্ষায় আমাদের দায়িত্ব পালন করি, তবেই এই গ্লোবাল ওয়ার্মিং সমস্যার কিছুটা হলেও সমাধান হবে। কারণ প্রকৃতি আমাদের জন্য নয়, আমরা প্রকৃতির অংশ সত্য বুঝলেই ইসলামি পরিবেশনীতি বাস্তবায়ন সহজ হবে এবং দুনিয়া ফিরে পাবে তার হারানো শান্তি ভারসাম্য।

 

 

Post a Comment

Previous Post Next Post