সুরা নূর (سورة النور) পবিত্র কুরআনের ২৪তম সূরা, যা মদিনায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এতে মোট ৬৪টি আয়াত রয়েছে। এই সূরাটি মূলত ইসলামী সমাজের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা এবং পারিবারিক জীবনের উপর গুরুত্বারোপ করে। এতে মুসলিম সমাজের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিধি-বিধান বর্ণনা করা হয়েছে, যা আজও আমাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক। সুরা নূরের আলোকে সামাজিক বিধানগুলি আলোচনা করা হলো:
১. শালীনতা ও দৃষ্টিশুদ্ধি বজায় রাখা
সুরা নূরের অন্যতম প্রধান শিক্ষা হল শালীনতা বজায় রাখা। মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য দৃষ্টিশুদ্ধি এবং লজ্জাস্থান হেফাজত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ۚ ذَٰلِكَ أَزْكَىٰ لَهُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ
"মুমিন পুরুষদের বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে
হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য পরিশুদ্ধি রয়েছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে
অবহিত।"
(সুরা নূর, ২৪:৩০)
وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَـٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَـٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ
"এবং মুমিন নারীদের
বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করে এবং যা সাধারণত
প্রকাশ পায় তা ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে।"
(সুরা নূর, ২৪:৩১)
এই বিধান আমাদের শেখায় যে, পুরুষ ও নারীদের জন্য শালীনতা ও দৃষ্টিশুদ্ধি বজায় রাখা অপরিহার্য, যা একটি নৈতিক সমাজ গঠনে সহায়ক।
২. ব্যভিচার ও তার শাস্তি
সুরা নূরে ব্যভিচারের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান দেওয়া হয়েছে। ইসলামে ব্যভিচারকে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা সমাজের নৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
ٱلزَّانِيَةُ وَٱلزَّانِي فَٱجْلِدُوا۟ كُلَّ وَٰحِدٍۢ مِّنْهُمَا مِا۟ئَةَ جَلْدَةٍۢ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌۭ فِى دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ
"ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ, উভয়ের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো।
যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান রাখো, তবে তোমাদের যেন তাদের প্রতি কোন অনুকম্পা
কাজ না করে।"
(সুরা নূর, ২৪:২)
এই বিধান ব্যভিচারকে সমাজ থেকে নির্মূল করার জন্য প্রণীত হয়েছে এবং এতে একটি সুস্থ ও নৈতিক সমাজ গড়ার উদ্দেশ্য রয়েছে।
৩. মিথ্যা অপবাদ ও তার পরিণতি
মিথ্যা অপবাদ ও চরিত্রহনন ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। যারা সৎ নারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাদের জন্য কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَٱلَّذِينَ يَرْمُونَ ٱلْمُحْصَنَـٰتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا۟ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَآءَ فَٱجْلِدُوهُمْ ثَمَـٰنِينَ جَلْدَةًۭ وَلَا تَقْبَلُوا۟ لَهُمْ شَهَـٰدَةً أَبَدًۭا
"যারা সৎ নারীকে ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, অতঃপর চারজন সাক্ষী উপস্থাপন করতে
ব্যর্থ হয়, তাদেরকে আশি বেত্রাঘাত কর এবং তাদের সাক্ষ্য চিরকালের জন্য প্রত্যাখ্যান
কর।"
(সুরা নূর, ২৪:৪)
এই বিধান চরিত্রহনন রোধ করার জন্য প্রণীত হয়েছে, যা একটি সমাজকে গুজব ও মিথ্যা অপবাদ থেকে রক্ষা করে।
৪. ইফকের ঘটনা এবং এর শিক্ষা
সুরা নূরে ইফকের ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে মুমিন নারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা মিথ্যা অপবাদের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কতা প্রদান করেছেন।
আল্লাহ বলেন:
لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ ٱلْمُؤْمِنُونَ وَٱلْمُؤْمِنَـٰتُ بِأَنفُسِهِمْ خَيْرًۭا وَقَالُوا۟ هَـٰذَآ إِفْكٌۭ مُّبِينٌۭ
"তোমরা যখন এটি শুনেছিলে, তখন মুমিন পুরুষ ও নারীরা নিজেদের সম্পর্কে ভালো
ধারণা রাখেনি কেন? তারা কেন বলেনি, ‘এটি একটি সুস্পষ্ট মিথ্যা’?"
(সুরা নূর, ২৪:১২)
এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া যায় যে, মুমিনদের উচিত মিথ্যা অপবাদে কান না দিয়ে সতর্ক থাকা এবং সৎ ধারণা পোষণ করা।
৫. পারিবারিক জীবনের নির্দেশনা
সুরা নূরে পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অবিবাহিতদের জন্য বিয়ে করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সহায়ক।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَأَنكِحُوا۟ ٱلْأَيَـٰمَىٰ مِنكُمْ وَٱلصَّـٰلِحِينَ مِنْ عِبَادِكُمْ وَإِمَآئِكُمْ ۚ إِن يَكُونُوا۟ فُقَرَآءَ يُغْنِهِمُ ٱللَّهُ مِن فَضْلِهِ
"তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত, তাদেরকে বিয়ে করাও এবং তোমাদের দাস-দাসীদের
মধ্যেও যারা উপযুক্ত তাদের বিয়ে করাও। তারা যদি দরিদ্র হয় তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে
তাদেরকে সমৃদ্ধ করবেন।"
(সুরা নূর, ২৪:৩২)
এটি সমাজে অবৈধ সম্পর্ক ও ব্যভিচার প্রতিরোধে সহায়ক।
৬. ঘরে প্রবেশের আদব
সুরা নূরে অন্যের ঘরে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা পারস্পরিক সম্মান ও সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوا۟ لَا تَدْخُلُوا۟ بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّىٰ تَسْتَأْنِسُوا۟ وَتُسَلِّمُوا۟ عَلَىٰٓ أَهْلِهَا
"হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যদের ঘরে তাদের অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করো না, তাদের প্রতি
সালাম দান করা ব্যতীত। এতে তোমাদের জন্য কল্যাণ রয়েছে।"
(সুরা নূর, ২৪:২৭)
এটি সামাজিক সম্পর্ককে উন্নত করে এবং পরস্পরের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে উৎসাহিত করে।
৭. আল্লাহর আলো (নূর)
সুরা নূরের একটি বিখ্যাত আয়াত হল "আয়াত আন-নূর", যেখানে আল্লাহ তাআলা নিজের আলোকে একটি বিশেষ উপমার মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
ٱللَّهُ نُورُ ٱلسَّمَـٰوَٰتِ وَٱلْأَرْضِ ۚ مَثَلُ نُورِهِۦ كَمِشْكَوٰةٍۢ فِيهَا مِصْبَاحٌ ۖ ٱلْمِصْبَاحُ فِى زُجَاجَةٍۢ
"আল্লাহ আসমান ও জমিনের নূর (আলো)। তাঁর আলো যেন একটি কুপের মত, যার মধ্যে
একটি প্রদীপ আছে। সেই প্রদীপটি একটি স্বচ্ছ কাঁচের মধ্যে।"
(সুরা নূর, ২৪:৩৫)
এই আয়াতটি আধ্যাত্মিকতা ও আল্লাহর হিদায়াতের আলোকে নির্দেশ করে, যা মানুষের জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করে।
উপসংহার
সুরা নূর আমাদের নৈতিক ও সামাজিক জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এর বিধানগুলি পারিবারিক শুদ্ধাচার, শালীনতা, সম্মান ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক। এই বিধানগুলি মেনে চললে সমাজে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা, এবং সুরা নূরের এই সামাজিক বিধানগুলি সেই জীবন ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ।
আল্লাহ আমাদেরকে সুরা নূরের শিক্ষা মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
প্রশ্ন : সুরা নুরের আলোকে সামাজিক বিধি-বিধান
