ইসলামী সমাজে যুবকদের ভূমিকা


যুবসমাজ একটি জাতির প্রাণশক্তি। তারা আগামীর ভবিষ্যৎ গঠন করে এবং সমাজের উন্নতি বা অবনতি অনেকাংশে তাদের উপর নির্ভর করে। যুবকরা যদি সঠিক পথ অনুসরণ করে, তাহলে সমাজ উন্নতির দিকে ধাবিত হয়; অন্যদিকে, যদি তারা ভুল পথে চলে, তবে সমাজে নৈতিক অবক্ষয় নেমে আসে। ইসলামী সমাজে যুবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তারা শুধু ভবিষ্যৎ নির্মাতা নয়, বরং বর্তমান সমাজেরও প্রধান চালিকাশক্তি। ইসলামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নবী করিম (সা.)-এর অধিকাংশ সাহাবী ছিলেন যুবক, যারা ইসলামের প্রচার, প্রতিরক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অসাধারণ অবদান রেখেছেন।

ইসলামে যুবকদের গুরুত্ব

ইসলামে যুবকদের গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন ও হাদিসে বহুবার যুবকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলা হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে,

"যারা আমাদের পথে সংগ্রাম করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেব।" (সূরা আনকাবুত: ৬৯)

এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, আল্লাহ তাদেরই পথ প্রদর্শন করেন, যারা সৎ পথে চলে এবং নিজেদের শুদ্ধ রাখার চেষ্টা করে। যুবকরাই সমাজে পরিবর্তন আনতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে পারে।

হাদিসেও যুবকদের গুরুত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেছেন,

"কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণির মানুষকে আরশের ছায়ায় স্থান দেওয়া হবে। তাদের মধ্যে একজন হল সেই যুবক, যে যৌবনে আল্লাহর ইবাদতে নিয়োজিত ছিল।" (বুখারি ও মুসলিম)

এ থেকে বোঝা যায়, একজন যুবক যদি তার যৌবনকালকে আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তাহলে তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ রয়েছে।

ইসলামী সমাজ গঠনে যুবকদের ভূমিকা

১. ন্যায় ও সততা প্রতিষ্ঠা

যুবকদের প্রধান দায়িত্ব হলো ন্যায় ও সততার পথে থাকা এবং অন্যদেরও সে পথে চলতে উদ্বুদ্ধ করা। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় যুবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজে যদি যুবকরা সত্যবাদী ও ন্যায়ের অনুসারী হয়, তবে অন্যায় ও দুর্নীতি কমে আসবে।

কুরআনে বলা হয়েছে,

"তোমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সাক্ষ্য দাও।" (সূরা মায়েদা: ৮)

যুবকরা যদি নিজেদের জীবনে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখে, তবে ইসলামী সমাজে সুস্থ নৈতিকতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।

২. জ্ঞানার্জন ও শিক্ষার প্রসার

যুবকরাই সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার মূল বাহক। তারা যদি জ্ঞানের আলোকে নিজেদের আলোকিত করে, তবে সমাজ আরও উন্নত হবে। ইসলামে জ্ঞানার্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

নবী (সা.) বলেছেন,

"জ্ঞান অর্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর-নারীর জন্য ফরজ।" (ইবন মাজাহ)

একজন শিক্ষিত যুবক কুসংস্কার, অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থেকে সমাজকে আলোর পথে পরিচালিত করতে পারে।

৩. সমাজ সংস্কারে নেতৃত্ব প্রদান

যুবকরাই সমাজ সংস্কারের প্রধান শক্তি। তারা যদি অন্যায় ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে সমাজ থেকে অনেক সমস্যা দূর করা সম্ভব হবে। বর্তমান যুগে মাদক, দুর্নীতি, ব্যভিচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ সমাজের মূল সমস্যাগুলোর একটি।

ইসলামে বলা হয়েছে,

"তোমরা মন্দ কাজকে হাত দিয়ে প্রতিহত করো, যদি তা না পারো, তাহলে মুখ দিয়ে প্রতিহত করো; যদি তাও না পারো, তবে অন্তরে ঘৃণা করো, আর এটি হলো সবচেয়ে দুর্বল ঈমান।" (মুসলিম)

যুবকদের উচিত অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া এবং সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করা।

৪. প্রযুক্তি ও আধুনিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির উন্নতি সমাজ পরিবর্তনে বিশাল ভূমিকা রাখছে। মুসলিম যুবকদের উচিত প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে ইসলামের প্রচার, শিক্ষা ও সমাজসেবায় অবদান রাখা।

একজন মুসলিম যুবক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে কুরআন শিক্ষা, হাদিস চর্চা, ইসলামী গবেষণা ও সমাজসেবা করতে পারে।

৫. মানবসেবায় নিয়োজিত হওয়া

ইসলাম কেবল ইবাদত নয়, বরং মানবসেবাও একটি বড় দায়িত্ব। নবী করিম (সা.) বলেছেন,

"তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে মানুষের উপকারে আসে।" (আল-মুজামুল আওসাত)

যুবকদের উচিত গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করা, বন্যা বা দুর্যোগের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সমাজের দুর্বল শ্রেণির মানুষের কল্যাণে কাজ করা।

৬. পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন

একজন যুবকের দায়িত্ব শুধু নিজের উন্নতি করা নয়, বরং পরিবার ও সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা রয়েছে। একজন সচেতন যুবক তার পরিবারকে ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে, সমাজকে ইসলামের আলোকে পরিচালিত করতে পারে।

যুবকদের জন্য কিছু করণীয়

যুবকদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হলে কিছু করণীয় বিষয় অনুসরণ করা উচিত। যেমন:

  1. নামাজ ও ইবাদতে যত্নশীল হওয়া: নামাজ একজন মুসলিমকে সকল অন্যায় থেকে দূরে রাখে।
  2. কুরআন অধ্যয়ন করা: কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করলে একজন যুবক ন্যায়নিষ্ঠ হতে পারে।
  3. ভাল সঙ্গী নির্বাচন করা: ভাল বন্ধুরা একজন যুবককে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
  4. সময়ের সদ্ব্যবহার করা: অলসতা ও সময়ের অপচয় থেকে বেঁচে থাকা এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাজে লাগানো।
  5. অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া: সমাজে মাদক, দুর্নীতি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো।
  6. পরিশ্রম ও ধৈর্যশীল হওয়া: জীবনে সফল হতে হলে পরিশ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন।


যুবকরাই একটি জাতির ভবিষ্যৎ। তারা যদি সঠিক পথে চলে, তবে সমাজ উন্নতির দিকে ধাবিত হবে; আর যদি তারা বিভ্রান্ত হয়, তবে সমাজ নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হবে। ইসলামী সমাজের উন্নয়নে যুবকদের আত্মশুদ্ধি, জ্ঞানার্জন ও সমাজ সংস্কারের পথে আত্মনিয়োগ করা জরুরি। যুবকরাই ইসলামের সঠিক আদর্শ ধারণ করে মানবতার কল্যাণে কাজ করতে পারে।

তাই, ইসলামী সমাজের যুবকদের উচিত নিজেদের চরিত্র গঠন করা, ন্যায় ও সত্যের পথে থাকা এবং মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ করা। তাহলেই ইসলামী সমাজ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী সমাজে পরিণত হবে, ইনশাআল্লাহ।

Post a Comment

Previous Post Next Post