কাজী নজরুল ইসলামের জীবন থেকে আমরা কী শিখতে পারি?

This may contain: an old black and white photo of a man

 
কাজী নজরুল ইসলাম  আমাদের জাতীয় কবি, বিদ্রোহী সাহিত্যিক ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী একজন মহান ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবন কেবল সাহিত্যিক কীর্তিতে নয়, বরং সংগ্রাম, আত্মবিশ্বাস, সাম্য ও মানবতার প্রতি অটল নিষ্ঠার জন্য আজও সকল বয়সের মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস।চলুন জেনে নেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন থেকে আমরা যা যা শিখতে পারি -

 সংগ্রামী জীবনের পাঠ : 

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন শুরু হয়েছিল কঠিন বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। তিনি খুব অল্প বয়সেই পিতাকে হারান এবং দরিদ্রতার কারণে শৈশবে তাকে মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতে হয়। জীবিকার তাগিদে রুটির দোকানে কাজ করেছেন, আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এই সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নিজের সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গেছেন।
এটা আমাদের শেখায়, জীবনের শুরু যদি কষ্টের হয়, তাও লক্ষ্য ও অধ্যবসায় থাকলে সাফল্য অর্জন সম্ভব। তিনি কখনো নিজের দারিদ্র্যকে বাধা মনে করেননি, বরং নিজের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। আধুনিক তরুণ সমাজের জন্য এটি একটি বড় শিক্ষা কোনো কিছুই আসলে অজুহাত নয়। প্রতিকূলতা, দারিদ্র্য কিংবা সীমাবদ্ধতা সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে যারা এগিয়ে যায়, তারাই একদিন ইতিহাসে স্থান করে নেয়। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন আমাদের শেখায়, হাল ছেড়ে দেওয়া নয়, বরং লড়াই করে টিকে থাকার নামই হলো জীবন।

 বিদ্রোহ ও ন্যায়ের প্রতি অবিচলতা :

নজরুল ইসলামকে বলা হয় “বিদ্রোহী কবি”। কারণ তিনি সমাজে প্রচলিত অন্যায়, শোষণ, কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখনীর মাধ্যমে সাহসিকতার সঙ্গে প্রতিবাদ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি বলেন, “আমি চির-বিদ্রোহী বীর, বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা রবে।” এই বক্তব্য শুধু কবিতার অলংকার নয়; বরং এটি ছিল তাঁর আত্মদর্শনের প্রকাশ। নজরুল যে সমাজে বসবাস করতেন, সেখানে মুসলমানরা পিছিয়ে ছিল, নারীরা অধিকারহীন ছিল, গরিবেরা শোষিত ছিল। তিনি এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন।
তাঁর এই বিদ্রোহী চেতনা আমাদের শেখায় যেখানে অন্যায়, সেখানে প্রতিবাদ করতে হবে। নীরব থাকা মানে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া। আজকের তরুণ সমাজের মাঝে এই মানসিকতা অত্যন্ত জরুরি। তবে নজরুলের বিদ্রোহ ছিল গঠনমূলক। তিনি ধ্বংস করতে নয়, গড়ে তুলতে চেয়েছেন। তার জীবন থেকে আমরা শিখতে পারি সাহস ও ন্যায়বোধ থাকলে সমাজকে পরিবর্তন করা সম্ভব। বিদ্রোহ মানে অরাজকতা নয়, বরং সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে নির্ভয়ে দাঁড়িয়ে যাওয়া।  

ধর্মীয় সম্প্রীতি ও সাম্য:

নজরুল ইসলামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস। তিনি মুসলমান হয়েও হিন্দু দেবদেবীকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, আবার ইসলামী ভাবধারায় অসংখ্য গজল, হামদ ও নাত রচনা করেছেন। তাঁর লেখনীতে তিনি বারবার বলেছেন ধর্ম নয়, মানুষই বড়। তিনি বিশ্বাস করতেন, সব ধর্মের মূল কথা হলো শান্তি ও মানবতা। তাই তিনি সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় বিভেদকে ঘৃণা করতেন। ‘ধর্মের নামে বিভাজন’ তার কাছে ছিল মানবতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।
এই শিক্ষা আমাদের আজকের প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যখন সমাজে ধর্ম নিয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিভাজন তৈরি হয়, তখন নজরুলের লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় সব ধর্মের মানুষকেই সম্মান করা উচিত। তিনি তাঁর বিখ্যাত কবিতায় বলেছিলেন, “মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।” এই লাইন আজও মানুষের হৃদয়ে সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দেয়। কাজী নজরুল ইসলামের জীবন থেকে আমরা শিখি মানবতাই সর্বোচ্চ ধর্ম, এবং সব মানুষ সমান মর্যাদার অধিকারী। 

 সৃষ্টিশীলতা ও সংস্কৃতির চর্চা:

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একজন কবিই ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক বহুমাত্রিক শিল্পী। তিনি গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, গান, উপন্যাস সব মাধ্যমেই অবাধ বিচরণ করেছেন। বাংলা সংগীত জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। নজরুলগীতির মাধ্যমে তিনি একটি সম্পূর্ণ ধারার সৃষ্টি করেছেন যা আজও জনপ্রিয় ও হৃদয়ছোঁয়া। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ছিল নিখাদ, সমাজমনস্ক এবং উদ্দীপনাময়। তিনি সাহিত্যে নারী স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবিক বোধকে তুলে ধরেছেন।আমাদের জন্য শিক্ষার বিষয় হলো সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রযুক্তির এই যুগে আমরা অনেকেই কেবল ভোগবাদী হয়ে যাচ্ছি। অথচ সাহিত্য, সংগীত, চিত্রকলা, কিংবা অভিনয়ের মাধ্যমে আমরা নিজের চিন্তা ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারি, যা অন্যদের চিন্তা জাগ্রত করে।
নজরুলের মতো মানুষ আমাদের শেখায় সৃষ্টিশীলতা কেবল বিনোদন নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ারও হতে পারে। একজন শিক্ষার্থী, তরুণ, কিংবা সাধারণ মানুষ যদি নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করে, তবে তা নিজেকে এবং সমাজকে সমৃদ্ধ করতে পারে।

 মানবতা ও ভালোবাসার দৃষ্টান্ত:

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন নিখাদ মানবতাবাদী। তাঁর লেখনীতে সর্বদা নিপীড়িত, গরিব, নারী ও প্রান্তিক মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহানুভূতির প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিশ্বাস করতেন, ধর্ম, জাতি, বর্ণ সব ছাড়িয়ে মানুষই মানুষের আসল পরিচয়। নজরুল নারীর মর্যাদা নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন,  “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” এটি কেবল কবিতা নয়, নারী-পুরুষের সমতার একটি দৃঢ় বার্তা। তেমনই, দরিদ্রদের জন্য তাঁর হৃদয়ে সবসময় জায়গা ছিল। তিনি ধনী-গরিব বিভেদকে তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন এবং শ্রেণি-সচেতন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন।
এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের পৃথিবীতে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। যখন আমরা জাতিগত ঘৃণা, বৈষম্য ও অহংকারে ভরে উঠছি, তখন নজরুল আমাদের মনে করিয়ে দেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো “মানুষ” হওয়া। তাঁর জীবন আমাদের শেখায় ভালোবাসা ও সহানুভূতি দিয়েই পৃথিবীকে বদলে ফেলা যায়। তিনি ছিলেন সেই কণ্ঠস্বর, যিনি শুধু কবিতায় নয়, হৃদয়ে হৃদয়ে মানবতার দীপ্তি ছড়িয়ে গেছেন।

 

কাজী নজরুল ইসলাম শুধুমাত্র একজন কবি নন, তিনি একজন বিপ্লবী, মানবতাবাদী ও চিরতরুণ আদর্শ। তাঁর জীবন আমাদের শিখিয়ে যায়, প্রতিকূলতার মাঝেও আশার আলো জ্বালাতে হয়, সাহস ও সত্যকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে হয়। নজরুলের জীবন ও সাহিত্য আমাদের জন্য চিরকালীন অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

 


 

Post a Comment

Previous Post Next Post