বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ, যেখানে প্রতিবছরই বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে। বন্যার পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকলেও, ভারতের ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবকাঠামো বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার নদীগুলো যেমন গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা এবং মেঘনা এই অঞ্চলের পানি প্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। ভারতের বাঁধ ও ব্যারেজসহ বিভিন্ন পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বাংলাদেশের ওপর বন্যার চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া দুই দেশের মধ্যে বন্যা ব্যবস্থাপনা, পানি ভাগাভাগি ও বন্যা পূর্বাভাসের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।
ভারতের ভূমিকা ও প্রভাব
১. বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ
ভারত নদীর পানি নিয়ন্ত্রণে অনেক বাঁধ ও ব্যারেজ নির্মাণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের তিস্তা নদীতে নির্মিত বাঁধ বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে। বর্ষাকালে ভারতে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে, ভারত থেকে অতিরিক্ত পানি ছাড়া হয়, যা বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে প্রবল বন্যার কারণ হতে পারে। আবার শুষ্ক মৌসুমে ভারতের বাঁধগুলো পানির প্রবাহ কমিয়ে রাখে, ফলে বাংলাদেশের নদীগুলিতে পানির অভাব দেখা দেয়।
ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার পানির ভাগাভাগির বিষয়ে অনেক বছর ধরে আলোচনা চলছে, তবে এটি এখনও একটি স্পর্শকাতর ও বিতর্কিত বিষয়। উদাহরণ হিসেবে, তিস্তা নদীর পানির ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এখনো চুক্তি হয়নি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে ভারতের পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রায়ই বাংলাদেশের বন্যার তীব্রতাকে প্রভাবিত করে থাকে।
২. গঙ্গার পানি চুক্তি
গঙ্গার পানি চুক্তি ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল গঙ্গা নদীর পানি যৌথভাবে ব্যবহার ও পরিচালনা করা। এই চুক্তির মূল উদ্দেশ্য ছিল পানির সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করা। তবে বাস্তবিক অর্থে, গঙ্গার পানি নিয়ন্ত্রণ প্রায়ই ভারত দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। ভারত গঙ্গার ওপর নির্মিত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি নিয়ন্ত্রণ করে, যা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। পানি ছাড়া এবং সংরক্ষণে ভারসাম্যহীনতা বন্যার তীব্রতা বাড়াতে পারে।
৩. আন্তঃদেশীয় আলোচনা ও সহযোগিতা
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানির ভাগাভাগি ও বন্যা মোকাবেলায় একাধিক আলোচনা হয়েছে। তিস্তা চুক্তি, গঙ্গার পানি চুক্তি এবং অন্যান্য আন্তঃদেশীয় আলোচনার মাধ্যমে বন্যা ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে এই চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন এবং কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা চুক্তির দীর্ঘসূত্রিতা বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে।
অন্যদিকে, ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রায়শই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে বাংলাদেশে বড় ধরনের বন্যার সৃষ্টি হয়। বিশেষত, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার ফলে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি এবং জনগণের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়ে।
আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা
বন্যা ব্যবস্থাপনা শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না, বরং এটি একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যেমন নেপাল, ভুটান এবং চীনও এই অঞ্চলের নদীগুলির পানি প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাউথ এশিয়ান এসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কোঅপারেশন (SAARC) এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্যা মোকাবেলায় আঞ্চলিক পর্যায়ে একযোগে কাজ করার জন্য উদ্যোগ নিয়েছে। এসব সংগঠন পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, বন্যার পূর্বাভাস এবং সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর চেষ্টা করে।
১. বন্যার পূর্বাভাস ও মনিটরিং
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্যার পূর্বাভাস নিয়ে সহযোগিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি প্রবাহের পরিবর্তন, নদীর উচ্চতা, এবং বৃষ্টিপাতের তথ্য ভাগাভাগি করা বন্যার পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ও ভারত একত্রে বন্যা পূর্বাভাস সিস্টেম স্থাপন করতে পারে যা জনগণকে আগাম প্রস্তুতির সুযোগ দেবে। তবে, এই তথ্য বিনিময় প্রায়শই যথাযথভাবে এবং সময়মতো হয় না, যা বড় ধরনের বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
২. পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি ও পানি সংরক্ষণ
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্যা ব্যবস্থাপনা নিয়ে পরিবেশগত দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করা জরুরি। পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে পানির সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের বাঁধ এবং ব্যারেজ নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে পানির স্তর কমে যাচ্ছে, যা শুষ্ক মৌসুমে পানির ঘাটতি সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, বর্ষাকালে ভারতে অতিরিক্ত পানি ছাড়ার ফলে আকস্মিক বন্যা দেখা দেয়, যা কৃষি ও মানুষের জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা ও উদ্যোগ
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। দুই দেশের মধ্যে আরও সমন্বয় এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দুই দেশকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং আন্তঃদেশীয় চুক্তিগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা, যেমন SAARC-এর মাধ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে যাতে নদীগুলির পানি প্রবাহ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বন্যার ঝুঁকি কমানো যায়।
বন্যার মত বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা আবশ্যক। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে দুই দেশ তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে পারে এবং এ অঞ্চলে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কমাতে পারে।

