ইসলামী দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীরতর তাত্ত্বিক প্রশ্ন হলো, মানুষ কি তার ইচ্ছায় স্বাধীন (حرية الإرادة) নাকি সে আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত তাকদীরের (القدر) অধীনে আবদ্ধ? এ বিষয়টি নিয়ে কালাম শাস্ত্রবিদদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা ও মতপার্থক্য দেখা যায়। তাদের মতামতগুলো মূলত তিনটি প্রধান মতবাদে বিভক্ত: জবরিয়া (الجبرية), কাদারিয়া (القدرية), এবং আশাআরিয়া বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ (الأشعرية / أهل السنة والجماعة)।
১. জবরিয়া (الجبرية) মতবাদ
জবরিয়া মতবাদ অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ তার কর্মে সম্পূর্ণভাবে বাধ্য (مجبور) এবং তার কোনো ইচ্ছা বা স্বাধীনতা নেই। তাদের মতে, মানুষের সকল কাজ আল্লাহ তাআলার পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনার (تقدير الله) অংশ এবং সে আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কিছুই করতে পারে না।
মূল দৃষ্টিভঙ্গি:
- তাদের ধারণা অনুযায়ী, মানুষ শুধু আল্লাহর নির্ধারিত লিপির (قضاء الله) অনুসারী; সে কোনো স্বাধীন কর্মক্ষমতা রাখে না।
- কুরআনের একটি বিখ্যাত আয়াত:
- "وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ"
"তোমরা কিছুই ইচ্ছা করতে পারো না, যদি না আল্লাহ ইচ্ছা করেন।" (সূরা আল-ইনসান, ৭৬:৩০) - তাদের মতে, মানুষ একটি কৃষ্ট পুতুলের মতো যা আল্লাহর ইচ্ছায় পরিচালিত হয়।
সমালোচনা:
- এই মতবাদ মানবজীবনে জবাবদিহিতা (المسؤولية) এবং কর্মের প্রতিফল (جزاء) বিষয়ে দ্বিধার সৃষ্টি করে।
২. কাদারিয়া (القدرية) মতবাদ
কাদারিয়া মতবাদ হলো জবরিয়ার চরম বিপরীত। এই মতবাদ অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে, মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং তার ইচ্ছার (الإرادة) ওপর ভিত্তি করে তার সকল কাজ সংঘটিত হয়। তাদের মতে, আল্লাহ মানুষকে পূর্ণ স্বাধীনতা ও শক্তি (القدرة) দিয়েছেন এবং সে তার কাজের জন্য নিজেই দায়ী।
মূল দৃষ্টিভঙ্গি:
- তারা যুক্তি দেন যে, মানুষকে আল্লাহ স্বাধীন ইচ্ছা ও চয়ন করার ক্ষমতা দিয়েছেন (حرية الاختيار) এবং সে তার কর্মের জন্য পুরস্কৃত বা শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
- কুরআনের একটি বিখ্যাত আয়াত:
- "مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَيْهَا"
"যে সৎ কাজ করে, তা তার নিজের জন্য এবং যে মন্দ কাজ করে, তার প্রতিফল তারই ওপর পড়বে।" (সূরা ফুসসিলাত, ৪১:৪৬) - হাদিস থেকেও প্রমাণ পাওয়া যায়:
- "اعملوا فكل ميسر لما خلق له"
"তোমরা কাজ করো, কারণ প্রত্যেকের জন্য তার নির্ধারিত পথ সহজ করে দেয়া হয়েছে।" (সহীহ মুসলিম)
সমালোচনা:
- এই মতবাদ আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তা (قدرة الله المطلقة) ও সর্বজ্ঞানের (علم الله) সাথে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হয়, কারণ এতে আল্লাহর ইচ্ছার চেয়ে মানুষের ইচ্ছাকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়।
৩. আশাআরিয়া (الأشعرية) বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ (أهل السنة والجماعة) মতবাদ
আশাআরিয়া বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ হলেন মধ্যমপন্থী (الوسطية) মতাবলম্বী। তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ তাআলা মানুষকে সীমিত ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা (كسب) দিয়েছেন, তবে সেই কর্মক্ষমতা আল্লাহর চূড়ান্ত ইচ্ছার (مشيئة الله) অধীন। অর্থাৎ, মানুষ স্বাধীনভাবে কাজ করার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু সফলতা একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
মূল দৃষ্টিভঙ্গি:
- তারা "কাসব" (الكسب) ধারণা পেশ করেন, যেখানে মানুষের ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সমন্বিত হয়।
- কুরআনের প্রমাণ:
- "وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ مَا اقْتَتَلُوا"
"আল্লাহ ইচ্ছা করলে, তারা যুদ্ধ করত না।" (সূরা আল-বাকারা, ২:২৫৩) - "إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُوا مَا بِأَنْفُسِهِمْ"
"নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে।" (সূরা আর-রাদ, ১৩:১১) - তাদের মতে, মানুষ তার কাজের জন্য দায়ী, কিন্তু তার ইচ্ছা ও শক্তি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণের অধীনে।
সমালোচনা:
- এই মতবাদ আল্লাহর ক্ষমতা ও মানুষের ইচ্ছার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে, তবে অনেকেই একে কঠিন এবং জটিল বলে মনে করেন।
উপসংহার
ইচ্ছা স্বাধীনতা (حرية الإرادة) নিয়ে কালাম শাস্ত্রবিদদের মধ্যে বিদ্যমান মতবিরোধ ইসলামী দর্শনের গভীর ও জটিল একটি বিষয়।
জবরিয়া ও কাদারিয়া দুটি চরম অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করে, যেখানে জবরিয়া আল্লাহর চূড়ান্ত ইচ্ছাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং কাদারিয়া মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়। অন্যদিকে, আশাআরিয়া বা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ একটি মধ্যমপন্থা গ্রহণ করে, যেখানে তারা মানুষের সীমিত স্বাধীনতা এবং আল্লাহর সর্বশক্তিমত্তার মধ্যে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করে।
সারমর্ম
ইসলামী বিশ্বদর্শনে ইচ্ছা স্বাধীনতার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ মানুষের দায়িত্ববোধ (المسؤولية الفردية), জবাবদিহিতা (المحاسبة), এবং তাকদীরের বিশ্বাস (الإيمان بالقضاء والقدر) বিষয়গুলোর সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। এই মতবাদগুলো ইসলামী ধর্মবিশ্বাস এবং এর অনুসারীদের জীবনধারাকে প্রভাবিত করে, যা ঈমানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।
এই কারণে, ইচ্ছা স্বাধীনতা সম্পর্কে এই আলোচনা শুধু তাত্ত্বিক নয়, বরং এটি ইসলামী জীবনচর্চার একটি মৌলিক ভিত্তি।
প্রশ্ন : ইচ্ছা স্বাধীনতা সম্পর্কে কালাম শাস্ত্রবিদদের মতামত আলোচনা কর।
