ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী ব্যভিচারের শাস্তি একটি গুরুতর বিষয়, যা পবিত্র কুরআন ও হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয়েছে। ইসলামে ব্যভিচার (যিনা) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং এটি একটি বড় অপরাধ বলে গণ্য। ব্যভিচারের শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে অপরাধীর বৈবাহিক অবস্থা এবং সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে। আসুন, ব্যভিচারের শাস্তি সম্পর্কিত বিস্তারিত বিধানগুলো আলোচনা করা যাক।
ব্যভিচারের সংজ্ঞা (যিনা)
যিনা বা ব্যভিচার বলতে বোঝায় যে, কোনো পুরুষ ও নারী যদি বৈধ বিবাহ বন্ধন ছাড়া যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে, তাহলে সেটিকে যিনা বলা হয়। ইসলামে এটি কঠোরভাবে হারাম এবং পাপের অন্তর্ভুক্ত।
ব্যভিচারের শাস্তি: কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী
ব্যভিচারের শাস্তি নির্ভর করে অপরাধীর বৈবাহিক অবস্থার উপর:
১. অবিবাহিত ব্যক্তির জন্য শাস্তি (গাইর মুহসান)
যদি কোনো অবিবাহিত পুরুষ বা নারী ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তাহলে তাদের জন্য ইসলামী শরীয়তে নির্ধারিত শাস্তি হলো:
- ১০০ বেত্রাঘাত এবং
- এক বছর নির্বাসন (যদি ইসলামি রাষ্ট্রে হয়)।
কুরআনের প্রমাণ:
"ٱلزَّانِيَةُ وَٱلزَّانِى فَٱجْلِدُوا۟ كُلَّ وَٰحِدٍۢ مِّنْهُمَا مِا۟ئَةَ جَلْدَةٍۢ ۖ وَلَا تَأْخُذْكُم بِهِمَا رَأْفَةٌۭ فِى دِينِ ٱللَّهِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِٱللَّهِ وَٱلْيَوْمِ ٱلْـَٔاخِرِ ۖ وَلْيَشْهَدْ عَذَابَهُمَا طَآئِفَةٌۭ مِّنَ ٱلْمُؤْمِنِينَ"
(সূরা আন-নূর, ২৪:২)
অনুবাদ:
"ব্যভিচারিণী নারী ও ব্যভিচারী পুরুষ—তোমরা প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো। আল্লাহর বিধান
বাস্তবায়নে তাদের প্রতি তোমাদের কোনো মমতা যেন না হয়, যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালের
প্রতি ঈমান রাখো। এবং তাদের শাস্তি কার্যকর করার সময় মুমিনদের একটি দল যেন তা প্রত্যক্ষ
করে।"
ব্যাখ্যা:
- এই আয়াতে অবিবাহিত ব্যভিচারীদের শাস্তি হিসাবে ১০০ বেত্রাঘাতের বিধান দেওয়া হয়েছে।
- শাস্তি কার্যকর করার সময় কিছু মুমিন ব্যক্তি যেন উপস্থিত থাকে, যাতে এটি সমাজের জন্য একটি সতর্কতা হয়ে দাঁড়ায়।
- শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে কোনো সহানুভূতি দেখানো যাবে না, যদি সত্যিকারের ঈমানদার হও।
হাদিসের প্রমাণ:
- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"إِذَا زَنَى الْأَيِّمُ أَجْلِدُوهُ مِائَةَ جَلْدَةٍ وَنَفُوهُ سَنَةً"
(সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১৬৯৮)
অনুবাদ:
"যদি কোনো অবিবাহিত পুরুষ বা মহিলা ব্যভিচার করে, তবে তাদের একশত বেত্রাঘাত করো
এবং এক বছর নির্বাসনে পাঠাও।"
২. বিবাহিত ব্যক্তির জন্য শাস্তি (মুহসান)
যদি কোনো বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচারে লিপ্ত হয়, তবে তার শাস্তি হলো:
- রজম (পাথর নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড)
হাদিসের প্রমাণ:
- রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
"أَخَذَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ) عَلَى أَهْلِ الذِّمَّةِ أَنْ لاَ يُحْدِثُوا وَلاَ يَزْنُوا وَلاَ يَقْتُلُوا النَّفْسَ"
(সহিহ বুখারি)
- রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় বিবাহিত ব্যভিচারীদের ক্ষেত্রে রজমের শাস্তি কার্যকর করেছেন। যেমন, মায়েজ আসলামী (রা.) এবং গামিদিয়া মহিলার ক্ষেত্রে।
ব্যভিচারের শাস্তির শর্তাবলী
ব্যভিচারের শাস্তি কার্যকর করার জন্য কঠোর শর্তাবলী রয়েছে। এগুলো নিশ্চিত করতে হয় যে, শাস্তি দেওয়ার আগে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে:
১. চারজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য
- চারজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সাক্ষী অপরাধটিকে স্বচক্ষে দেখেছেন এবং একই বক্তব্য প্রদান করেছেন।
"وَٱلَّذِينَ يَرْمُونَ ٱلْمُحْصَنَـٰتِ ثُمَّ لَمْ يَأْتُوا۟ بِأَرْبَعَةِ شُهَدَآءَ فَٱجْلِدُوهُمْ ثَمَـٰنِينَ جَلْدَةًۭ وَلَا تَقْبَلُوا۟ لَهُمْ شَهَـٰدَةً أَبَدًۭا ۚ وَأُو۟لَـٰٓئِكَ هُمُ ٱلْفَـٰسِقُونَ"
(সূরা আন-নূর, ২৪:৪)
অনুবাদ:
"যারা পবিত্র নারীদের ওপর ব্যভিচারের মিথ্যা অভিযোগ আনে এবং চারজন সাক্ষী উপস্থিত
করে না, তাদেরকে আশি বেত্রাঘাত করো এবং কখনোই তাদের সাক্ষ্য গ্রহণ করো না।"
২. অপরাধীর স্বীকারোক্তি
- অপরাধী যদি চারবার নিজে অপরাধ স্বীকার করে।
৩. মিথ্যা অভিযোগের শাস্তি
- যারা মিথ্যা অভিযোগ করে, কিন্তু প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তাদের শাস্তি হলো আশি বেত্রাঘাত এবং তাদের সাক্ষ্য অগ্রাহ্য করা হবে।
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তির উদ্দেশ্য
ইসলামী শরীয়তে ব্যভিচারের কঠোর শাস্তির পেছনে মূল উদ্দেশ্য হলো:
- নৈতিকতা রক্ষা করা: সমাজে নৈতিকতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
- পরিবারের সংহতি: পরিবার ও সমাজকে বিশৃঙ্খলা থেকে রক্ষা করা।
- সতর্কীকরণ: সমাজের অন্যদের জন্য একটি সতর্কবার্তা প্রদান করা।
- পাপের প্রতিরোধ: মানুষকে বড় পাপ থেকে বিরত রাখা।
উপসংহার
ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি কঠোর হলেও এর পেছনে রয়েছে সমাজের বৃহত্তর কল্যাণ ও মানুষের নৈতিকতা রক্ষা করার উদ্দেশ্য। ইসলামী আইন ব্যবস্থায় সবসময় ন্যায়বিচার ও প্রমাণের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে শাস্তি দেওয়া হয় না। এভাবে, ইসলামী শাস্তি ব্যবস্থা মানুষের জীবন ও সমাজকে সুস্থ ও সুশৃঙ্খল রাখার জন্য কাজ করে।
