মানুষের জীবনে সময় হলো সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এটি একবার চলে গেলে কখনও আর ফিরে আসে না। পৃথিবীর সবকিছু কেনা সম্ভব হলেও সময়কে কেনা যায় না। ইসলাম, যা মানুষের পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, এই সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে গভীরভাবে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কুরআন ও হাদীসের আলোকে সময়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনা একজন মুসলমানের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। এই প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব, কৌশল, উদাহরণ এবং আধুনিক জীবনে এর প্রাসঙ্গিকতা আলোচনা করা হবে।
সময়ের শপথ: কুরআনের দৃষ্টিতে সময়
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা কুরআনে একাধিক স্থানে সময়ের শপথ করেছেন। যেমন:
- "والعصر إن
الإنسان لفي خسر"
"শপথ যুগের (সময়ের), নিশ্চয় মানুষ ক্ষতিতে রয়েছে" (সূরা আসর: ১-২) - "والفجر"
"শপথ ফজরের (ভোরের)" (সূরা ফজর: ১) - "والليل
إذا يغشى والنهار إذا تجلى"
"শপথ রাতের যখন তা ঢেকে দেয়, শপথ দিনের যখন তা উদিত হয়" (সূরা লায়ল: ১-২)
আল্লাহ যখন কোনো কিছুর শপথ করেন, তা সেই বস্তুর গুরুত্ব নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, সময় কেবল একটি সীমিত উপকরণ নয়, বরং একটি ইবাদত ও জবাবদিহির বিষয়।
সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব
১. জবাবদিহিতার ভিত্তি
হাদীসে এসেছে,
“কিয়ামতের দিন বান্দাকে চারটি বিষয়ে জিজ্ঞেস না করে এক কদমও সরতে দেওয়া হবে না— তার জীবন কীভাবে অতিবাহিত করল,
তার যৌবন কী কাজে ব্যয় করল, সম্পদ কোথা থেকে আয় করল ও কোথায় ব্যয় করল, আর সে কী পরিমাণ জ্ঞান অর্জন করেছে এবং তা অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।”
(তিরমিজি)
এ হাদীস স্পষ্ট করে যে, সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে।
২. সফলতার চাবিকাঠি
যে ব্যক্তি সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগায়, সে ব্যক্তি ব্যক্তি জীবনে, শিক্ষাজীবনে, পেশাজীবনে এবং আখিরাতের সফলতায় সমৃদ্ধ হয়। একজন মুসলমানের জন্য সফলতা শুধুমাত্র দুনিয়ার নয়, বরং আখিরাতের চিরস্থায়ী কল্যাণও অন্তর্ভুক্ত।
নবীজীর (সা.) জীবনে সময় ব্যবস্থাপনা
নবী মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর জীবন ছিল সময় ব্যবস্থাপনার উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি দিনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে পালন করতেন:
- ইবাদতের সময়: তাহাজ্জুদ, ফজরের পর, রাতে সময় নির্ধারিত।
- দাওয়াত ও শিক্ষা: সাহাবিদের শিক্ষাদান, মানুষকে দাওয়াত প্রদান।
- সামাজিক কাজ: মসজিদ নির্মাণ, যুদ্ধ পরিচালনা, বিচার কাজ।
- পরিবারের সময়: স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে সময় কাটানো।
- ব্যক্তিগত সময়: চিন্তাভাবনা, আত্মসমালোচনা।
উহুদ যুদ্ধের সময় হোক বা মক্কা বিজয়ের সময়— তাঁর সময় ব্যবস্থাপনা ছিল এতটাই নিখুঁত যে একই দিনে তিনি একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পারতেন।
সময় নষ্টের পরিণাম
ইসলামে অলসতা ও সময় নষ্ট করার কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
"দুইটি নিয়ামত আছে, যা অধিকাংশ মানুষ তার প্রকৃত মূল্য জানে না: স্বাস্থ্য এবং অবসর সময়।" (বুখারি)
যারা সময়ের অপব্যবহার করে, তারা জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। এরা নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সমাজকেও ক্ষতির মুখে ফেলে।
সময় ব্যবস্থাপনার ইসলামি কৌশল
১. নিয়ত এবং লক্ষ্য নির্ধারণ
ইসলামে প্রতিটি কাজের ভিত্তি হলো নিয়ত।
"নিয়ত অনুযায়ীই প্রতিফল দেওয়া হবে।"
(বুখারি)
সময় ব্যবস্থাপনায় নিয়ত পরিষ্কার রাখা এবং জীবনকে লক্ষ্যভিত্তিক করা অত্যন্ত জরুরি।
২. সালাতভিত্তিক সময় ভাগ
একজন মুসলমানের দিনের সূচি সালাতের ভিত্তিতে গঠিত হওয়া উচিত:
- ফজর: আত্মউন্নয়ন ও পরিকল্পনার সময়
- যুহর: কর্মক্ষেত্রের মাঝখানে সাময়িক প্রশান্তি
- আছর: কাজ শেষের প্রস্তুতি
- মাগরিব: পরিবার বা আত্মিক উন্নয়ন
- এশা: আত্মসমালোচনা ও বিশ্রাম
৩. সময়ের তালিকা তৈরি
প্রতিদিনের কাজ একটি তালিকাভিত্তিক হলে অপ্রয়োজনীয় কাজ বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো অগ্রাধিকার পায়। কুরআনেও এসেছে:
"আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মসমূহ তার গলায় ঝুলন্ত থাকবে..." (সূরা ইসরা: ১৩)
যা বোঝায় যে প্রতিটি কাজ নথিভুক্ত হচ্ছে; আমাদেরও উচিত সময়ের হিসাব রাখা।
৪. ত্বাকওয়া বা আল্লাহভীতি
আল্লাহভীতি মানুষকে দায়িত্ববান করে তোলে। যে ব্যক্তি জানে, তার সময়ের হিসাব দিতে হবে, সে সময়ের সদ্ব্যবহার করে।
৫. বন্ধুমহল ও সামাজিক পরিবেশ
ভালো বন্ধু সময়ের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সাহায্য করে। কুরআন বলে:
"হে মুমিনগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সৎ লোকদের সঙ্গে থাকো।" (সূরা তাওবা: ১১৯)
আধুনিক জীবনে সময় ব্যবস্থাপনার প্রাসঙ্গিকতা
বর্তমান যুগে সময় ব্যবস্থাপনা আরও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন গেম, এবং অন্যান্য সময়গ্রাসী মাধ্যম সময় নষ্টের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুসলমানদের উচিত প্রযুক্তিকে সময় বাঁচানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা, অপব্যবহার নয়।
কিছু বাস্তব কৌশল:
- মোবাইলে সময় নির্ধারণ করে ব্যবহার করা
- সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় রাখা
- পড়াশোনার নির্দিষ্ট রুটিন তৈরি
- ‘Pomodoro
Technique’ (২৫ মিনিট কাজ, ৫ মিনিট বিশ্রাম) ব্যবহার
উপসংহার
ইসলামে সময় ব্যবস্থাপনা একটি গভীর ধর্মীয় ও বাস্তবিক বিষয়। এটি কেবল একটি দক্ষতা নয়, বরং ইমানের অংশ। যারা সময়ের মূল্য বোঝে, তারাই দুনিয়া ও আখিরাতে সফল হয়। আমাদের উচিত নবীজীর (সা.) জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিদিনের সময়কে ইবাদত, জ্ঞান অর্জন, কাজ এবং উপকারমূলক কাজে বিনিয়োগ করা। সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের জন্য একটি পরীক্ষার উপকরণ— সেটিকে উত্তমভাবে কাজে লাগানোই হবে আমাদের দায়িত্ব।
সংক্ষিপ্ত মূল বক্তব্য
- সময় একটি আমানত।
- কুরআন ও হাদীসে সময়ের গুরুত্ব বারবার বলা হয়েছে।
- নবীজী (সা.) ছিলেন সময় ব্যবস্থাপনার শ্রেষ্ঠ আদর্শ।
- সময় নষ্ট করা মানে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ নষ্ট করা।
- সালাতভিত্তিক সময় ভাগ, তালিকা তৈরি, নিয়তের বিশুদ্ধতা ও আল্লাহভীতি সময় ব্যবস্থাপনায় সহায়ক।
- প্রযুক্তিকে সময় বাঁচানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।
