
একটি দেশের সার্বিক উন্নয়নের ভিত্তি হলো শিক্ষা। একটি উন্নত, দক্ষ ও মানবিক সমাজ গঠনের জন্য শিক্ষার অবদান অপরিসীম। কিন্তু এই শিক্ষাক্ষেত্রের মানোন্নয়ন অনেকাংশেই নির্ভর করে সরকারের বাজেট বরাদ্দের ওপর। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের যথার্থতা ও কার্যকারিতা বারবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে, বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ করা হচ্ছে তা কি যথেষ্ট? কিংবা সেই অর্থ কি সঠিকভাবে কাজে লাগছে?
এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের ইতিহাস, বর্তমান অবস্থা, বরাদ্দের কার্যকারিতা, সঠিক ব্যবহার, সমস্যাসমূহ এবং সমাধানের দিকগুলো নিয়ে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করব।
শিক্ষা বাজেট
বাংলাদেশে প্রতিবছর জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বরাদ্দ করা হয়। এটি মূলত তিনটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়:
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়
- প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়
- কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ
জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে শতকরা যে অংশ বরাদ্দ হয় তা জিডিপি’র তুলনায় তুলনামূলক কম। UNESCO-এর সুপারিশ অনুযায়ী, একটি দেশে জিডিপির ৬% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হওয়া উচিত। অথচ বাংলাদেশে এই হার ২%-এর আশেপাশে ঘোরাফেরা করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট অনুযায়ী, মোট বাজেটের প্রায় ১১.৮৫% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, যা জিডিপির মাত্র ১.৭৬%।
এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, শিক্ষা খাতকে প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আমরা এখনও পিছিয়ে রয়েছি।
বরাদ্দের বৈষম্য ও খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ
শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের মধ্যে বৈষম্য স্পষ্ট। বড় অংশটাই ব্যয় হয় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে। ফলস্বরূপ, পাঠ্যক্রম উন্নয়ন, গবেষণা, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, লাইব্রেরি ও ল্যাবরেটরি উন্নয়ন কিংবা প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ কম পড়ে যায়।
উদাহরণস্বরূপ:
- প্রাথমিক শিক্ষা: বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হয় শিক্ষকদের বেতন দিতে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ের মান উন্নয়ন, শেখার পদ্ধতিতে আধুনিকতা আনা, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ হয় না।
- মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক: অবকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দ বাড়লেও শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও পাঠদানের মান উন্নয়নে তেমন নজর দেওয়া হয় না।
- উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যাপ্ত বরাদ্দ না পাওয়ায় গবেষণার পরিবেশ খুবই সীমিত হয়ে পড়ে।
বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
শুধুমাত্র বাজেট বরাদ্দ করলেই সমস্যা সমাধান হয় না, তার সঠিক বাস্তবায়নও জরুরি। কিন্তু এখানে দেখা যায়, বাজেটের বড় একটি অংশ সময়মতো খরচ হয় না বা অব্যবহৃত রয়ে যায়। বাজেট ব্যবহারে জটিলতা, দুর্নীতি, পরিকল্পনার অভাব এবং রাজনৈতিক প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হওয়ায় বরাদ্দকৃত অর্থ অনেক সময় অপচয় হয় কিংবা প্রকৃত উপকারভোগীরা তা পান না।
আন্তর্জাতিক তুলনা
শিক্ষা বাজেটের আন্তর্জাতিক তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান হতাশাজনক।
- মালয়েশিয়া: জিডিপির ৪.৭%
- ভিয়েতনাম: জিডিপির ৫.৮%
- নেপাল: জিডিপির ৪.১%
এই দেশগুলো শিক্ষায় বিনিয়োগ করে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশেরও উচিত শিক্ষা বাজেটের হার বাড়িয়ে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানো।
শিক্ষা বাজেটের ইতিবাচক দিকসমূহ
যদিও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তারপরও কিছু ইতিবাচক দিক লক্ষ্য করা যায়:
- শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম: বিশেষ করে মেয়েদের জন্য, এটি ঝরে পড়ার হার কমাতে সহায়ক হয়েছে।
- ফ্রি পাঠ্যবই বিতরণ: বছরের শুরুতেই বই বিতরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে আগ্রহ তৈরি হয়।
- প্রযুক্তির ব্যবহার: 'শিক্ষা টেলিভিশন' বা 'মাল্টিমিডিয়া ক্লাস' চালু হওয়ায় ধীরে ধীরে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
যথার্থ বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবনা
· জিডিপির অন্তত ৪-৬% শিক্ষা খাতে বরাদ্দ: এটা শুধু UNESCO-এর নির্দেশনা পূরণ নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গঠনের জন্য একটি বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ।
· গবেষণাভিত্তিক বাজেট: উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য পৃথক এবং পর্যাপ্ত বাজেট থাকা উচিত।
· প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ: স্কুল/কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী বাজেট বরাদ্দ করে কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
· কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষার বিস্তার: শিক্ষিত কিন্তু কর্মহীন জনগোষ্ঠী তৈরি না করে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বাজেট বরাদ্দের অগ্রাধিকার প্রয়োজন।
· শিক্ষক প্রশিক্ষণে বরাদ্দ বৃদ্ধি: মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত শিক্ষক অপরিহার্য।
· বাজেট ব্যবহারে প্রযুক্তির প্রয়োগ: যাতে খরচ স্বচ্ছ হয় এবং অনলাইনে ট্র্যাক করা যায়।
সমাজ ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব
যদি শিক্ষা খাতে যথাযথভাবে বাজেট বরাদ্দ ও ব্যবহৃত হয়, তাহলে—
- দক্ষ ও সৃজনশীল মানবসম্পদ তৈরি হবে
- বেকারত্ব কমবে এবং উদ্যোক্তা তৈরি হবে
- অসাম্য হ্রাস পাবে
- নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে
- সামাজিক অপরাধ কমবে
- দীর্ঘমেয়াদে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে
শিক্ষা কেবল একটি খাত নয়; এটি জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ড যত দৃঢ় হবে, জাতি তত উন্নত হবে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা খাত এখনও উপেক্ষিত। বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ, তার সুষম বণ্টন এবং যথাযথ ব্যবহারের অভাব আমাদের উন্নয়নের গতিকে মন্থর করে দিচ্ছে।
তাই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, গবেষণাভিত্তিক বাজেট বণ্টন এবং দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা। বাজেট কেবল কাগজে-কলমে নয়, তা বাস্তবায়িত হওয়া চাই শিক্ষার্থীর বেঞ্চ থেকে শুরু করে গবেষণাগার পর্যন্ত।
এক কথায়, শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের যথার্থতা নিশ্চিত করাই হবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম মূল চাবিকাঠি।