বিশ্বায়ন একটি বাস্তবতা,
যা বর্তমান বিশ্বে প্রতিটি সমাজ,
সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রের ওপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এটি এমন এক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল অর্থনীতি,
রাজনীতি,
সংস্কৃতি,
প্রযুক্তি ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে একে অপরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হচ্ছে। তবে বিশ্বায়নের এই ছোঁয়া যেমন সুবিধা নিয়ে এসেছে,
তেমনি অনেক ক্ষেত্রে তা প্রথাগত সংস্কৃতি ও বিশ্বাসব্যবস্থার জন্য চ্যালেঞ্জও হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামী সংস্কৃতি এ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে একটি শক্তিশালী বিশ্বাস,
নৈতিকতা ও ঐতিহ্যের ধারক হিসেবে। একদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে জীবনধারার পরিবর্তন, সামাজিক সম্পর্কের নতুন রূপ,
ভাষা ও পোশাকের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে;
অন্যদিকে ইসলামী সংস্কৃতি এখনও ব্যক্তির আত্মিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তি হিসেবে শক্ত অবস্থানে রয়েছে।ইসলামী সংস্কৃতি কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান বা রীতিনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা মানুষের চিন্তা-চেতনা,
আচরণ,
সমাজ-সংগঠন,
শিক্ষা,
অর্থনীতি,
রাজনীতি,
এমনকি নৈতিক মানদণ্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। ইসলামী সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হল আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, রাসুল (সা.)-এর আদর্শ অনুসরণ,
কুরআনের নির্দেশনা এবং শরিয়াহ-ভিত্তিক ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন। এই সংস্কৃতিতে আত্মিক উন্নয়ন, পারিবারিক বন্ধন, প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ববোধ, ধৈর্য, ইখলাস, ইনসাফ এবং হালাল-হারামের স্পষ্ট সীমারেখা বিদ্যমান।
অন্যদিকে,
বিশ্বায়ন মূলত পশ্চিমা আধিপত্যের ফল, যেখানে ভোগবাদ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, ধর্মনিরপেক্ষতা,
মুক্ত যৌনতা,
বাজার নির্ভর সংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর জীবনধারাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এই সংস্কৃতি ক্রমশই মুসলিম সমাজে ঢুকে পড়ছে বিজ্ঞাপন,
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম,
চলচ্চিত্র,
ফ্যাশন ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। ফলশ্রুতিতে অনেক মুসলিম যুবক-যুবতী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে গিয়ে পশ্চিমা জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।তবে এটা বলাও ভুল হবে না যে, বিশ্বায়নের ফলে ইসলাম প্রচারের জন্যও সুযোগ তৈরি হয়েছে। আজকের ডিজিটাল যুগে ইসলামী জ্ঞান ও দাওয়াহ ছড়িয়ে দেওয়া অনেক সহজ হয়েছে। একজন মুসলিম এখন ঘরে বসেই কুরআন শিখতে পারছে, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের ইসলামী বক্তার বক্তব্য শুনতে পারছে এবং নানা ভাষায় ইসলামিক বই পড়তে পারছে। অর্থাৎ প্রযুক্তির ব্যবহার ইসলামী সংস্কৃতিকে আরো বিস্তৃত করার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। তবুও দ্বন্দ্বটা এখানেই যে,
বিশ্বায়নের নামে যে তথাকথিত ‘উন্মুক্ততা’ ছড়ানো হচ্ছে, তা অনেক সময় ইসলামী আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ছে। যেমন,
নারী স্বাধীনতার নামে পর্দাহীনতা,
শিল্প ও সংস্কৃতির নামে অশ্লীলতা, আধুনিক শিক্ষার নামে নাস্তিকতা ও ধর্মবিদ্বেষ, স্বাধীন মত প্রকাশের নামে কুরআন ও হাদীস নিয়ে ব্যঙ্গ এগুলো মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষিত মুসলিম তরুণরা দ্বিধার মধ্যে পড়ছে একদিকে আধুনিক জীবনের চাহিদা,
অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ।
এই পরিস্থিতিতে সহাবস্থানের প্রশ্ন ওঠে। আদৌ কি ইসলামী সংস্কৃতি ও বিশ্বায়ন একসঙ্গে টিকে থাকতে পারে?
বাস্তবতা হলো,
সহাবস্থান সম্ভব তবে তা শর্তসাপেক্ষে। ইসলাম সব যুগে টিকে আছে তার নিজস্ব নমনীয়তা ও নীতির দৃঢ়তার কারণে। ইসলাম পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে অস্বীকার করে না,
বরং তার অনৈতিক দিকগুলো বাদ দিয়ে ইতিবাচক অংশগুলো গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। বিশ্বায়নের যে দিকগুলো মানবকল্যাণে সহায়ক,
যেমন আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান,
যোগাযোগ প্রযুক্তি, জ্ঞান বিনিময়, বৈশ্বিক সহযোগিতা ইসলাম সেগুলোকে গ্রহণ করে। কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির যে দিকগুলো চারিত্রিক অবক্ষয়,
পারিবারিক বন্ধনের ভাঙন ও নৈতিকতার সংকট সৃষ্টি করে, সেগুলোর সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী।সহাবস্থানের জন্য দরকার একটি বুদ্ধিদীপ্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। একদিকে আমাদের বিশ্বায়নের উপকারী দিকগুলো গ্রহণ করতে হবে, যেমন প্রযুক্তি, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা শিক্ষা বিনিময়। অন্যদিকে ইসলামী মূল্যবোধ,
নৈতিকতা,
ঐতিহ্য ও পারিবারিক কাঠামোকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। এই ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে মুসলিম সমাজ বিশ্বায়নের প্রভাবে নিজস্বতা হারাবে না,
বরং আরও সমৃদ্ধ হবে।
একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও গণমাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতির যথাযথ উপস্থাপনা প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে নতুন প্রজন্ম ইসলামী ঐতিহ্য ও জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে পড়ছে। তারা ইসলামকে কেবল নামাজ-রোজার মধ্যেই সীমাবদ্ধ মনে করে। অথচ ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনদর্শন। সঠিকভাবে ইসলামী শিক্ষার প্রচার, পরিবারে নৈতিক শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ইসলামি রুচির চর্চা
এসবের মাধ্যমে ইসলামী সংস্কৃতি বিশ্বায়নের সঙ্গে একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ইতিহাসে ইসলাম যখনই অন্য সংস্কৃতির মুখোমুখি হয়েছে, তখন সেটি কেবল প্রতিরোধমূলক নয় বরং প্রভাব বিস্তারমূলক ভূমিকাও পালন করেছে। যেমন,
স্পেনে মুসলিম শাসন কালে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূচনা হয়,
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম হিন্দু-সংস্কৃতির মধ্যে ন্যায়বিচার ও সাম্যের বার্তা নিয়ে আসে। বর্তমান বিশ্বেও ইসলাম তার নৈতিকতা ও মানবিক বার্তার মাধ্যমে বিশ্বায়নের নেতিবাচক দিকগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।এই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস ও সুশিক্ষা। মুসলিম তরুণদের মধ্যে আত্মমর্যাদা ও ইসলামী পরিচয়বোধ জাগ্রত করতে হবে। তাদের জানতে হবে, ইসলাম আধুনিকতা-বিরোধী নয়, বরং সত্যিকারের আধুনিকতার পথপ্রদর্শক। এই বোঝাপড়া তৈরি করতে পারলেই বিশ্বায়নের ঢেউয়ের মাঝে ইসলামী সংস্কৃতি ডুবে যাবে না,
বরং দৃপ্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে।
সবশেষে বলা যায়,
ইসলাম ও বিশ্বায়নের দ্বন্দ্ব কোনো যান্ত্রিক বা কৃত্রিম বিষয় নয়। এটি বাস্তব সমাজ ও মানসিকতার দ্বন্দ্ব। এখানে একদিকে রয়েছে আল্লাহমুখী,
নৈতিকতাভিত্তিক,
আত্মিক ও পারিবারিক উন্নয়নের শিক্ষা; অন্যদিকে রয়েছে কেবল বাহ্যিক উন্নয়ন ও ভোগের নেশা। এই দ্বন্দ্বে মুসলিম সমাজকে বেছে নিতে হবে একটি আলোকিত,
দায়িত্বশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ পথ, যেখানে বিশ্বায়নের সুবিধাগুলো ইসলামী আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে গ্রহণ করা যায় এবং অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে নিজেদের রক্ষা করা যায়। এটি কঠিন হলেও অসম্ভব নয় যদি পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতৃত্ব এবং সচেতন নাগরিক একত্রে কাজ করে। তখন ইসলামী সংস্কৃতি শুধু বিশ্বায়নের সঙ্গে সহাবস্থান করবেই না,
বরং বিশ্বমানবতাকে একটি উচ্চতর আদর্শের দিকে আহ্বান জানাতেও সক্ষম হবে।
