ডেটা প্রাইভেসি কেন এখন এত গুরুত্বপূর্ণ?

 

বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ কার্যক্রমই ডিজিটাল মাধ্যমনির্ভর হয়ে পড়েছে। ব্যক্তিগত, সামাজিক, শিক্ষাগত, অর্থনৈতিক এমনকি রাজনৈতিক কাজকর্মও আজ ইন্টারনেট মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে। আমরা যেখানেই যাই, যা কিছু করি, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের কিছু না কিছু ব্যক্তিগত তথ্য অনলাইনে সংরক্ষিত হচ্ছে বা শেয়ার করা হচ্ছে। যেমন নাম, ঠিকানা, জন্মতারিখ, মোবাইল নম্বর, ব্যাংক একাউন্টের তথ্য, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, শিক্ষাগত যোগ্যতা, লোকেশন, ব্রাউজিং হিস্ট্রি, এমনকি আমাদের ব্যবহৃত পাসওয়ার্ডও। এই বিপুল পরিমাণ তথ্য আমাদের পরিচিতির ডিজিটাল রূপ বা 'ডিজিটাল আইডেন্টিটি' তৈরি করছে। তাই এখন ডেটা প্রাইভেসি বা তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ডেটা প্রাইভেসি বলতে বোঝায় ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য যেন তার অনুমতি ছাড়া অন্য কেউ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ব্যবহার বা শেয়ার না করতে পারে। এটি একজন ব্যবহারকারীর মৌলিক ডিজিটাল অধিকার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা প্রতিনিয়ত এমন সব ওয়েবসাইট, অ্যাপস এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছি, যারা আমাদের অজান্তেই আমাদের ডেটা সংগ্রহ করে থাকে। আপনি যখন ফেসবুকে কোনো কিছু সার্চ করেন বা গুগলে একটি পণ্য খুঁজেন, ঠিক কিছুক্ষণ পরেই আপনি দেখতে পান সেই পণ্যের বিজ্ঞাপন আপনার সামনে হাজির। এটি শুধু বিজ্ঞাপনের সুবিধার্থে নয়, বরং আপনার কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে আপনাকে লক্ষ্যবস্তু বানানোর একটি সূক্ষ্ম কৌশল।বিশ্বব্যাপী বহুবার ডেটা লিক, হ্যাকিং তথ্য চুরির ঘটনা ঘটেছে, যা প্রমাণ করে ডেটা এখন তেল বা সোনার চেয়েও মূল্যবান। ২০১৮ সালের কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কেলেঙ্কারিতে দেখা যায়, কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য রাজনীতিকদের হাতে চলে যায়, এবং সেই তথ্য ব্যবহার করে ভোটারদের মানসিকতা প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। এটি শুধু একটি ঘটনা নয়, বরং একটি বড় ধরনের সতর্কবার্তা। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই নয়, অর্থনৈতিক প্রতারণা, ব্ল্যাকমেইল, পরিচয় চুরি (identity theft) এবং সামাজিক ক্ষতি করার জন্যও এই ডেটাগুলো ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আরও জটিল। অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের ওয়েবসাইট বা অ্যাপে কোনো প্রাইভেসি পলিসি না রেখেই ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে। অনেক ব্যাংক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা -কমার্স প্ল্যাটফর্মেও নিরাপত্তার ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া, অনেক সাধারণ মানুষ এখনো জানে না কীভাবে নিজের ডেটা সুরক্ষিত রাখতে হয়। ফলে অনেকেই সহজেই প্রতারণার শিকার হন। বর্তমানে সাইবার অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং ডেটা চুরি তার অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ডেটা প্রাইভেসির গুরুত্ব শুধু প্রযুক্তিগত নিরাপত্তায় নয়, বরং মানসিক সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যখন একজন ব্যক্তি জানে তার ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষিত, তখন সে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারে। অন্যদিকে, ডেটা লিকের ফলে একজন মানুষের সামাজিক মানহানি, চাকরি হারানো, পারিবারিক ঝামেলা বা আর্থিক ক্ষতির মতো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। এজন্যই বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ ইতোমধ্যেই ডেটা প্রটেকশন আইন প্রণয়ন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের 'GDPR' (General Data Protection Regulation) আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীর তথ্য ব্যবহার করতে চাইলে তাকে প্রথমে স্পষ্টভাবে অনুমতি নিতে হয় এবং ব্যবহারকারী চাইলে তার তথ্য মুছে ফেলার অধিকার রাখে। বাংলাদেশেওতথ্য প্রযুক্তি আইন, ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন ইত্যাদি প্রণীত হয়েছে, তবে এখনো এর প্রয়োগ সচেতনতা সীমিত। বিশেষ করে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, বয়স্ক মানুষ বা প্রযুক্তিতে কম অভ্যস্ত মানুষরা এই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব কম জানে। অথচ তারাও প্রতিদিন অসংখ্য অ্যাপে বা সাইটে নিজের তথ্য দিচ্ছে, কোনো যাচাই ছাড়াই। তাই এখনই প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি এবং নীতিমালার কঠোর বাস্তবায়ন।

একজন সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে ডেটা প্রাইভেসি রক্ষা করা পুরোপুরি সম্ভব না হলেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে নিজেকে অনেকটা সুরক্ষিত রাখা যায়। যেমন সন্দেহজনক ওয়েবসাইটে তথ্য না দেওয়া, অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ ইনস্টল না করা, অ্যাপের পারমিশন নিয়ন্ত্রণ করা, অজানা লিংকে ক্লিক না করা, শক্তিশালী পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা, এবং দুই-স্তরের নিরাপত্তা চালু রাখা (Two-Factor Authentication) এছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে তথ্য শেয়ার করার আগে সেই প্রতিষ্ঠানের প্রাইভেসি পলিসি রেপুটেশন যাচাই করা উচিত। প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোরও বিষয়ে দায়িত্ব রয়েছে। তারা যেন ব্যবহারকারীর তথ্য সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে এবং স্বচ্ছ নীতিমালা মেনে চলে। অনেক সময় দেখা যায় বিশ্ববিখ্যাত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবহারকারীর তথ্য সংগ্রহ করে তা তৃতীয় পক্ষকে বিক্রি করছে, যা একেবারেই অনৈতিক। এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং ব্যবহারকারীর স্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি।

ডেটা প্রাইভেসি এখন আর কেবল প্রযুক্তিবিদদের আলোচনার বিষয় নয়; এটি প্রতিটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর জন্য জরুরি একটি বাস্তবতা। যতদিন আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করব, ততদিন আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা করতেই হবে। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র সবার উচিত এই বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া এবং একে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। কারণ, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা না থাকলে, ডিজিটাল স্বাধীনতাও নিরাপদ নয়

 


Post a Comment

Previous Post Next Post