বিশ্ব মুসলিম জাতিগোষ্ঠীকে যখন একত্রে ভাবা হয়, তখন তাদের মধ্যে একটি আদর্শিক ঐক্যের চিত্র উঠে আসে, যেটি ইসলামের মৌলিক আদর্শ, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে গঠিত। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্ব বহু রকম রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে এবং সেই বিভাজন দিন দিন আরও গভীর ও বহুমাত্রিক হয়ে উঠছে। এই বিভাজনের কারণসমূহ, প্রেক্ষাপট, ইতিহাস, পশ্চিমা ভূ-রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, সাম্প্রতিক যুদ্ধাবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ মতভেদসমূহকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়, মুসলিম বিশ্বের এই বিভাজন শুধুমাত্র রাজনৈতিক নয়; বরং এটি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শিকভাবেও প্রভাব ফেলেছে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল নবী (সা.)-এর হাতে, যার ফলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো বিভাজন ছিল না। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ইন্তেকালের পর খিলাফতের সময়কাল মুসলিম বিশ্বের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য বজায় রেখেছিল। তবে, হযরত ওসমান (রা.)-এর শাসনামলের শেষ দিকে এবং হযরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে শুরু হয় রাজনৈতিক মতপার্থক্য, যা ধীরে ধীরে একটি বিদ্বেষে পরিণত হয় এবং ইসলামী বিশ্বের প্রথম বড় বিভাজন সুন্নি ও শিয়া বিভাজনের জন্ম হয়। যদিও এই বিভাজন মূলত বিশ্বাস ও ব্যাখ্যার পার্থক্যের উপর ভিত্তি করে, তবে এটি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী রূপ লাভ করে এবং ইতিহাস জুড়ে মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে নানা রাজনৈতিক সংঘাতের জন্ম দেয়।
ঐতিহাসিকভাবে, উমাইয়া, আব্বাসীয় ও উসমানীয় খেলাফতের সময়ে মুসলিম বিশ্ব একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে উদিত হয়েছিল। কিন্তু কলোনিয়াল যুগে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর আগ্রাসন মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক কাঠামোকে ভেঙে দেয়। ব্রিটিশ ও ফরাসি উপনিবেশবাদ মুসলিম রাষ্ট্রগুলিকে কৃত্রিম সীমানার মধ্যে বিভক্ত করে দেয়, যার ফলস্বরূপ মুসলিম বিশ্ব একটি রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত ভূখণ্ডে পরিণত হয়। যেমন সাইকস-পিকো চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে কৌশলগতভাবে ভাগ করে ফেলা হয়, যা আজকের সিরিয়া, ইরাক, জর্ডান ও প্যালেস্টাইনের সংকটের মূল কারণগুলোর অন্যতম।
এছাড়া, ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মুসলিম বিশ্বের মধ্যে আরও একটি গভীর রাজনৈতিক ক্ষত সৃষ্টি করে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণ এবং মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এই ইস্যুতে ঐক্যহীনতা মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ব্যর্থতার অন্যতম দৃষ্টান্ত। একদিকে কিছু মুসলিম দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, অন্যদিকে কিছু দেশ এই সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে দেখে ফলে মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ঐক্যহীনতা আরও দৃঢ় হয়।
সমসাময়িক যুগে মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক বিভাজনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হতে পারে ইরান ও সৌদি আরবের বৈরিতা। এই দুই দেশ শুধুমাত্র ভৌগোলিকভাবে নয়, বরং মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিকভাবে মুখোমুখি। ইরান শিয়া নেতৃত্বাধীন একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্র যেখানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হয়, অন্যদিকে সৌদি আরব সুন্নি ওহাবি মতবাদের অনুসারী একটি রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন ও ইরাকে এই দুই দেশের পরোক্ষ যুদ্ধ এবং গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব মুসলিম বিশ্বের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক যুদ্ধকে স্পষ্ট করে তোলে। এই রাজনৈতিক বিভাজন কেবল মধ্যপ্রাচ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম দেশগুলোর মধ্যেও রাজনৈতিক মতভেদ এবং জাতীয়তাবাদের উত্থান মুসলিম ঐক্যের ধারনাকে চ্যালেঞ্জ করছে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক দূরত্ব কখনো কখনো উগ্র মতাদর্শকে জন্ম দিয়েছে। আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের ফিরে আসা এবং এই বিষয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের ভিন্নমত মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যকে চিহ্নিত করে।
একই সঙ্গে, তুরস্ক এবং কাতারের উদারপন্থি ইসলামিক রাজনৈতিক ধারার বিপরীতে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর ও সৌদি আরবের কঠোর ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও ইসলামপন্থা বিরোধিতা একটি আরেকটি রাজনৈতিক বিভাজনের জন্ম দিয়েছে। আরব বসন্তের সময়ে এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল কাতার ও তুরস্ক, বিপরীতে সৌদি ও ইউএই সমর্থন করেছিল সেনা অভ্যুত্থানকে। এই ঘটনাগুলো বিশ্বমুসলিমদের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি ও মতবিরোধকে আরও গভীর করেছে। অন্যদিকে, ওআইসি (অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন) নামে একটি বৃহৎ ইসলামিক সংস্থা থাকার পরও মুসলিম বিশ্ব কোনো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, চীন কর্তৃক উইঘুর মুসলিম নির্যাতন কিংবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে ব্যর্থতা প্রমাণ করে যে রাজনৈতিকভাবে মুসলিম দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ ও জোটনীতি নিয়েই বেশি ব্যস্ত। এই ব্যর্থতা শুধুমাত্র ইসলামি ঐক্যের জন্য হুমকি নয়, বরং তা বিশ্বরাজনীতিতে মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বকেও কমিয়ে দিয়েছে।
বিশ্লেষকগণ মনে করেন, মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক বিভাজনের পেছনে দুটি মূল কারণ কাজ করছে একটি হলো অভ্যন্তরীণ, আরেকটি বাহ্যিক। অভ্যন্তরীণভাবে মুসলিম দেশগুলোর অধিকাংশেই গণতান্ত্রিক কাঠামোর অভাব, ক্ষমতার কেন্দ্রিক রাজনীতি এবং মতপার্থক্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা রাজনৈতিক সংঘর্ষের জন্ম দিচ্ছে। অন্যদিকে, বাহ্যিকভাবে পশ্চিমা শক্তিগুলো বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও ইসরায়েল মুসলিম দেশগুলোকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে রেখে নিজেরা কৌশলগত লাভ নিচ্ছে। অস্ত্র ব্যবসা, তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ, সামরিক ঘাঁটি স্থাপন এবং ধর্মীয় উগ্রপন্থাকে উসকে দেওয়া এসব নীতির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, মুসলিম তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আজ এই রাজনৈতিক বিভাজনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সোশ্যাল মিডিয়া, আন্তর্জাতিক সংযোগ এবং বিকল্প গণমাধ্যমের মাধ্যমে তারা ঐক্যের ডাক দিচ্ছে এবং একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা করছে। তবে এই পথ সুগম নয়, কারণ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হলে নেতৃত্ব, দূরদৃষ্টি এবং আন্তরিক রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন, যা বর্তমান বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম শাসকের মধ্যে অনুপস্থিত।
মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক বিভাজন শুধু একটি ইতিহাসগত ব্যর্থতা নয়; বরং এটি একটি চলমান সংকট, যার কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠী বারবার নিপীড়িত ও দুর্বল অবস্থানে পতিত হচ্ছে। এই বিভাজন নিরসনের জন্য দরকার ইসলামি মূল্যবোধভিত্তিক রাজনীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মতানৈক্যের মধ্যেও ঐক্যের সূত্র খোঁজা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনগণের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং মানবিক নেতৃত্বের উত্থান। আর সেই পরিবর্তনের নেতৃত্ব হয়তো আসবে তরুণ প্রজন্মের মধ্য থেকেই, যারা নিজেদের পরিচয় শুধু রাষ্ট্র বা মতের ভিত্তিতে নয়, বরং একটি বৃহত্তর মানবিক ও ইসলামি ঐক্যের অংশ হিসেবে ভাবতে শিখেছে।
.png)