দান ও সমাজসেবার গুরুত্ব

 


মানবজীবনের নানান দিক উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম এক মহৎ দিক হলো দান সমাজসেবা। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাই তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সামাজিক সম্পর্ক, দায়-দায়িত্ব এবং মানবিকতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানুষের প্রকৃত মূল্য শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্যে নয়, বরং সে সমাজের জন্য কতটা উপকারী, তা দিয়েই বিচার করা যায়। সমাজে দান সমাজসেবা তাই কেবল একটি ভালো কাজ নয়, বরং এটি মানবিক দায়িত্ব এবং ধর্মীয় নৈতিক কর্তব্যও বটে। দান বলতে বোঝায় কাউকে স্বেচ্ছায়, বিনিময়বিহীনভাবে কিছু প্রদান করা, যা হতে পারে অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ কিংবা সময় শ্রম। সমাজসেবা হলো সমাজের সাধারণ মানুষের কল্যাণে কাজ করা, বিশেষ করে দরিদ্র, অসহায় পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কিছু করা। এই দুইটি ধারণা একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং একত্রে সমাজ গঠনে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। দান যেমন সরাসরি একটি অভাবী মানুষের প্রয়োজন মেটায়, সমাজসেবা তেমনি সেই প্রয়োজনগুলোকে সংগঠিত সুশৃঙ্খলভাবে পূরণ করার ব্যবস্থা করে। দান সমাজসেবার গুরুত্ব বহুমাত্রিক। 

প্রথমত, এটি মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে। যখন একজন ব্যক্তি অন্যের দুঃখ-কষ্ট দেখে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়, তখন তার মধ্যে করুণা, সহানুভূতি ভ্রাতৃত্ববোধের উদয় হয়। এইসব গুণ মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্ত করে সামষ্টিক কল্যাণচিন্তায় উদ্বুদ্ধ করে। সমাজে ধনী দরিদ্র, শিক্ষিত অশিক্ষিত, স্বাস্থ্যবান রোগাক্রান্ত মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও দান সমাজসেবা সেই ব্যবধানকে কিছুটা হলেও কমিয়ে আনে। এটি সামাজিক ভারসাম্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়।

দ্বিতীয়ত, দান সমাজসেবা সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করে তোলে। যারা দান করে এবং যারা সমাজসেবার কাজে নিয়োজিত থাকে, তারা সমাজের মানুষের সঙ্গে একটি সম্পর্ক গড়ে তোলে। এর মাধ্যমে পারস্পরিক বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ভালোবাসা গড়ে ওঠে। একটি সমাজ যত বেশি পরোপকারী মানুষে পূর্ণ হবে, সেই সমাজ তত বেশি শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ এবং মানবিক হবে। সমাজে সংঘর্ষ, অপরাধ এবং হিংসাত্মক মনোভাবের মূল কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অভাব অবহেলা। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যখন বারবার অবজ্ঞা বঞ্চনার শিকার হয়, তখন তাদের মধ্যে অসন্তোষ জন্ম নেয়, যা ধীরে ধীরে সমাজে বিশৃঙ্খলার জন্ম দেয়। অথচ সময়মতো দান সহায়তা পেলে সেই মানুষটিই সমাজের একজন দায়িত্বশীল সদস্যে পরিণত হতে পারে।

তৃতীয়ত, দান সমাজসেবা শুধু গ্রহীতার উপকারে আসে না, দাতাও এর সুফল ভোগ করে। ইসলাম ধর্মসহ পৃথিবীর সকল ধর্মেই দানের কথা বলা হয়েছে এবং এটিকে পুণ্য কল্যাণের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, “তোমরা যে দান করো, আল্লাহ তা জানেন এবং তিনি উত্তম প্রতিদান দানকারী। পবিত্র কুরআনে দানকে হাসনাহ অর্থাৎ উত্তম কাজ বলে অভিহিত করা হয়েছে। হাদীসে আছে, “দান করলে সম্পদ কমে না, বরং তা বৃদ্ধি পায়। দানের মাধ্যমে আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটে, অহংকার দূর হয় এবং অন্তরে প্রশান্তি আসে। যারা দান করে বা সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, তারা জীবনে একধরনের মানসিক প্রশান্তি লাভ করে, যা অন্য কোনো বস্তু দিয়ে অর্জন করা যায় না।

চতুর্থত, দান সমাজসেবা শিক্ষার প্রসার, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বাসস্থান সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উন্নত বিশ্বে যেমন বড় বড় এনজিও, ফাউন্ডেশন ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুল, হাসপাতাল, অন্নদান কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে দরিদ্র মানুষের জন্য কাজ করা হয়, ঠিক তেমনি আমাদের দেশেও এমন উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে। সমাজের প্রতিটি মানুষ যদি নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী কিছুটা দান করে এবং নিজ এলাকার মানুষদের জন্য কিছু সেবামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে, তাহলে একটি সুন্দর, মানবিক উন্নত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।

পঞ্চমত, দান সমাজসেবা একটি জাতিকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে। যারা দান গ্রহণ করেন বা সমাজসেবার দ্বারা উপকৃত হন, তারাও ধীরে ধীরে নিজেদের দক্ষতা আত্মবিশ্বাস অর্জন করে। এই সুযোগের মাধ্যমেই তারা ভবিষ্যতে সমাজের একজন দাতা বা সেবক হয়ে উঠতে পারেন। এতে সমাজে একটি ইতিবাচক চক্র তৈরি হয় যেখানে একদল মানুষ উপকৃত হয়ে পরবর্তীতে অন্যদের উপকার করে। এটি একটি সুস্থ গতিশীল সমাজের লক্ষণ। দান সমাজসেবা শুধুমাত্র কোন দুর্যোগ বা আপদকালীন সময়ে নয়, বরং প্রতিদিনকার জীবনের অংশ হওয়া উচিত। দুর্যোগের সময় যেমন বন্যা, খরা, অগ্নিকাণ্ড বা মহামারীর সময় আমাদের মাঝে সহানুভূতির স্ফুরণ ঘটে, তেমনি স্বাভাবিক সময়েও দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাবৃত্তি, গরিব রোগীদের চিকিৎসা সহায়তা কিংবা প্রতিবন্ধীদের সহায়তায় দান সেবা খুবই প্রয়োজন।

বর্তমানে তরুণ সমাজের মাঝে সমাজসেবার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা একটি শুভ লক্ষণ। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, চ্যারিটি, যুব সংগঠন অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তরুণরা সমাজের বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন শিক্ষাগতভাবে মানবিক গুণাবলীকে উৎসাহিত করা এবং পরিবার, স্কুল, মাদ্রাসা কলেজে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো। দান সমাজসেবা কেবল সমাজের নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং এটি সমাজের প্রত্যেক শ্রেণির জন্য প্রাসঙ্গিক। সমাজের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও কখনো কখনো সংকটে পড়ে, বিশেষত রোগ, দুর্ঘটনা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। এই ক্ষেত্রে সহানুভূতি সমবেদনার পাশাপাশি একটি সংগঠিত সহায়তা ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা দেখতে পাই, হাজারো মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা বাসস্থানের জন্য তাদের লড়াই করতে হয় প্রতিনিয়ত। অথচ এই দেশেই অনেক বিত্তবান, ক্ষমতাধর এবং সুসংগঠিত মানুষ বসবাস করেন, যাদের একটু সদিচ্ছা এইসব মানুষের জীবনে আশার আলো আনতে পারে। দেশের উন্নয়ন কেবল অবকাঠামো বা অর্থনীতির মাধ্যমে সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানবিক উন্নয়ন।

দান সমাজসেবা মানব জীবনের এক অপরিহার্য দিক। এটি শুধু মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠন করে না, বরং সমাজে সাম্য, সহমর্মিতা শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে। একটি দেশ যত বেশি দানশীল সমাজসেবায় অগ্রগামী হবে, ততই সে দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে। তাই আমাদের প্রত্যেকের উচিত, ব্যক্তি, পরিবার জাতিগত পর্যায়ে দান সমাজসেবাকে জীবনের একটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা। ছোট ছোট কাজের মাধ্যমেই বড় পরিবর্তনের সূচনা সম্ভব, যদি আমরা সকলে আন্তরিক হই। দান শুধু বিত্তবানদের কাজ নয়, বরং এটি হৃদয়বানদের কাজ, আর সমাজসেবা শুধু সময় দেওয়ার বিষয় নয়, বরং তা জীবনের উদ্দেশ্যও হতে পারে। এই উপলব্ধি সমাজকে বদলাতে পারে, গড়ে তুলতে পারে একটি সহানুভূতিশীল মর্যাদাপূর্ণ মানবসমাজ

 

Post a Comment

Previous Post Next Post