মানুষ জন্মের পর থেকেই শেখার একটি নিরবচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। প্রথমে পরিবার থেকে, পরে সমাজ থেকে, তারপর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, এবং অবশেষে পুরো জীবন জুড়ে মানুষ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করে। এই ধারাবাহিক শেখার প্রক্রিয়াই আজীবন শিক্ষা বা লাইফলং লার্নিং নামে পরিচিত। আজীবন শিক্ষার মূল দর্শন হলো শিক্ষা কখনো থেমে থাকে না, এটি নির্দিষ্ট কোনো বয়স, সময় কিংবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মানুষ যতদিন বেঁচে থাকে, ততদিনই নতুন জ্ঞান, দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ থেকে যায়। আধুনিক বিশ্বে এই ধারণা বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, কারণ প্রযুক্তি, সমাজ, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে একজন মানুষকে সবসময় শিখতে হয়।
আজীবন শিক্ষার মূল ভিত্তি দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্বাসের ওপর যে শিক্ষা কেবল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যম নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আত্মোন্নয়ন এবং সমাজের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। অতীতে শিক্ষা কেবল স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে বর্তমান বিশ্বে শিক্ষা আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের বাইরেও বিস্তৃত হয়ে গেছে। নতুন প্রযুক্তি, গবেষণা, পেশাগত উন্নয়ন, এমনকি দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতাও শিক্ষার অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাই একজন কৃষক যেমন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে চাষাবাদের কৌশল শিখতে পারেন, তেমনি একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারও সর্বশেষ প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে পারেন। এভাবেই শিক্ষা সমাজের প্রতিটি স্তরে একটি আজীবন চলমান প্রক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়। আজীবন শিক্ষার দর্শনে কয়েকটি মৌলিক দিক বিদ্যমান। প্রথমত, স্ব-প্রণোদিত শিক্ষা বা self-motivated learning। একজন মানুষকে সচেতনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে সে নিজেকে উন্নত করার জন্য নতুন কিছু শিখতে চায়। এর জন্য কৌতূহল, আগ্রহ এবং অধ্যবসায় অপরিহার্য। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা। বর্তমানে ইন্টারনেট এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে শেখার সুযোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এখন ঘরে বসেই অনলাইন কোর্স, ওয়েবিনার, ভিডিও টিউটোরিয়াল এবং ডিজিটাল লাইব্রেরির মাধ্যমে অসংখ্য বিষয় শেখা সম্ভব হচ্ছে। তৃতীয়ত, অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিক্ষা। কর্মক্ষেত্র, পরিবার, ভ্রমণ, সামাজিক কর্মকাণ্ড কিংবা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতাও জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে। এই অভিজ্ঞতা মানুষকে শুধুমাত্র একাডেমিক দিকেই নয়, বরং সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রেও পরিপূর্ণতা এনে দেয়। আজীবন শিক্ষার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো দক্ষতা উন্নয়ন। বর্তমান শ্রমবাজার ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। এক দশক আগে যে দক্ষতা খুব চাহিদাসম্পন্ন ছিল, আজ হয়তো তা অপ্রচলিত হয়ে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি নতুন দক্ষতার চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই একজন কর্মজীবী মানুষকে কেবল তার শিক্ষাজীবনে অর্জিত জ্ঞানের ওপর নির্ভর করলে চলবে না, বরং নতুন দক্ষতা অর্জনের জন্য ক্রমাগত শিখতে হবে। এটি শুধু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে না, বরং কর্মক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধাও এনে দেয়।
আজীবন শিক্ষার দর্শন শুধু পেশাগত নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও সমানভাবে কার্যকর। যখন একজন মানুষ বই পড়ে, ভ্রমণ করে, বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়, বা নতুন কোনো শখ গড়ে তোলে, তখন তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয়। এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত শেখার অভ্যাস মানুষকে মানসিকভাবে সক্রিয় রাখে এবং বয়সজনিত জটিলতা কমায়। ফলে ব্যক্তি জীবনের মান উন্নত হয় এবং তিনি দীর্ঘসময় ধরে সৃজনশীল থাকতে পারেন। শিক্ষার এই বিস্তৃত ধারণাটি সমাজ গঠনের ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সমাজ তখনই উন্নত হয় যখন তার নাগরিকেরা সারাজীবন শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের উন্নত করে। আজীবন শিক্ষা মানুষকে নৈতিকভাবে শক্তিশালী করে, সচেতন নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে। গণতান্ত্রিক সমাজে সঠিকভাবে অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার রক্ষা এবং বৈষম্য দূরীকরণে শিক্ষিত নাগরিকের ভূমিকা অপরিসীম। তাই আজীবন শিক্ষা একটি সমৃদ্ধ ও টেকসই সমাজ গঠনের অন্যতম ভিত্তি।
এছাড়া ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মেও আজীবন শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। ইসলামের প্রথম ওয়াহি ছিল “ইকরা” অর্থাৎ পড়ো। এর মাধ্যমে আজীবন জ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে উল্লেখ আছে যে, “শিক্ষা গ্রহণ করো মাতৃগর্ভ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।” এ থেকেই বোঝা যায়, শিক্ষা শুধু শৈশব বা যৌবনের জন্য সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষের পুরো জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আজীবন শিক্ষা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষামুখী হলেও, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী এটিকে পরিবর্তন করতে হবে। সরকার এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আজীবন শিক্ষা কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে, যেমন বয়স্ক শিক্ষা কর্মসূচি, অনলাইন শিক্ষা উদ্যোগ, গ্রামীণ শিক্ষার প্রসার এবং পেশাগত প্রশিক্ষণ। একইসঙ্গে পরিবার ও সমাজকেও আজীবন শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে সহায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে।
আজীবন শিক্ষার দর্শন একটি সার্বজনীন সত্যকে প্রতিফলিত করে, আর তা হলো মানুষ সবসময় শিখতে থাকে, আর শেখার মাধ্যমেই সে পরিপূর্ণতা লাভ করে। শিক্ষা কেবল কর্মসংস্থান বা ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আত্মোন্নয়ন, সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং মানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার পথ। তাই আজীবন শিক্ষা একটি জীবনদর্শন, যা মানুষকে সারা জীবন ধরে শিখতে, জানতে এবং নতুনকে গ্রহণ করতে অনুপ্রাণিত করে।
তথ্যসূত্র
- Dewey, John. Experience and Education. New York: Macmillan, 1938.
- Jarvis, Peter. Adult Education and Lifelong Learning: Theory and Practice. Routledge, 2004.
- Knowles, Malcolm S. The Modern Practice of Adult Education. Cambridge Books, 1980.
- UNESCO. Learning: The Treasure Within. Report to UNESCO of the International Commission on Education for the Twenty-first Century, 1996.
- আল-কুরআন, সূরা আল-আলাক, আয়াত ১-৫।
- আল-হাদিস, সুনানে ইবনে মাজাহ, কিতাব আল-সুনান।
