হালাল রিজিক কেন গুরুত্বপূর্ণ?

 

মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে হালাল রিজিকের গুরুত্ব অপরিসীম। রিজিক বলতে আমরা বুঝি জীবিকা, উপার্জন, খাওয়া-পরার ব্যবস্থা, যা মানুষ তার শ্রম, মেধা সুযোগ অনুযায়ী অর্জন করে থাকে। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে রিজিক কেবল উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং তা একটি নৈতিক, আধ্যাত্মিক সামাজিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পূরণ করতে হলে তা হতে হবে হালালঅর্থাৎ বৈধ শরিয়ত সম্মত। হালাল রিজিকের গুরুত্ব প্রথমেই আসে আল্লাহর আদেশ থেকে। পবিত্র কুরআনে বহু স্থানে আল্লাহ তায়ালা হালাল পাক রিজিক গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন, “হে রাসূলগণ! তোমরা পবিত্র বস্তুসমূহ ভক্ষণ কর এবং সৎকাজ কর। (সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৫১) এই নির্দেশ কেবল রাসূলদের জন্যই নয়, বরং সমগ্র মানবজাতির জন্য একটি মৌলিক নীতিরূপে বিবেচিত। হালাল রিজিক গ্রহণ করা মানে হচ্ছে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের পথে চলা।

হালাল হারাম উপার্জনের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা শুধু ইসলামী শরিয়তের নির্দেশ নয়, এটি ব্যক্তির আত্মিক পবিত্রতা, ইবাদত কবুল হওয়া এবং দুনিয়া আখিরাতের কল্যাণের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে, তার চুল এলোমেলো, ধুলাময়, সে হাত তুলে বলে: হে আমার রব! হে আমার রব! অথচ তার খাওয়া হারাম, পানীয় হারাম, পোশাক হারাম এবং সে হারাম উপার্জনে লালিত-পালিত হয়েছে; এমন অবস্থায় তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে?” (সহীহ মুসলিম) এই হাদিস আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, হালাল রিজিক না থাকলে, এমনকি একজন মানুষ দোয়াতে কান্নাকাটি করলেও তা কবুল নাও হতে পারে। কারণ আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের জন্য শুধু পবিত্রতা চান। হালাল রিজিকের মাধ্যমেই মানুষের আত্মা প্রশান্তি লাভ করে। হারাম উপার্জন মানুষকে পাপে লিপ্ত করে, অস্থিরতা সৃষ্টি করে, ঈমানকে দুর্বল করে এবং অন্তরে অন্ধকার ছড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, হালাল রিজিক যেমন উপার্জনকারীকে শান্তি দেয়, তেমনি তা তার পরিবার, সমাজ এবং জাতির মধ্যেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। হালাল রিজিকের মাধ্যমে পরিবারে বরকত আসে, সন্তানদের চরিত্র গঠন হয় সুন্দরভাবে এবং নৈতিকতা রক্ষা পায়।

এছাড়া হালাল উপার্জন ব্যক্তি সমাজকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলে। একজন হালাল উপার্জনকারী ব্যক্তি কখনো অসততা, প্রতারণা, চুরি, সুদ কিংবা ঘুষের আশ্রয় নেয় না। এর মাধ্যমে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা পায়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং একটি সৎ আদর্শিক পরিবেশ গড়ে ওঠে। অন্যদিকে, হারাম উপার্জন ব্যক্তি সমাজকে ধ্বংস করে দেয়। সমাজে দুর্নীতি, ঘুষ, চুরি, প্রতারণা অবিচারের বিস্তার ঘটে। ফলে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ, অশান্তি অবিশ্বাস তৈরি হয়। হালাল রিজিকের গুরুত্ব বোঝাতে গেলে আমাদের সমাজের বাস্তবতাও পর্যালোচনা করতে হবে। বর্তমান সময়ে চাকরি, ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো উপার্জনের পথে অনেকেই বিভিন্ন শর্টকাট বা হারাম পথে রিজিক অর্জন করছে। কেউ সুদের লেনদেন করে, কেউ ঘুষের মাধ্যমে সম্পদ গড়ছে, কেউ প্রতারণা করে ব্যবসায় লাভবান হচ্ছে। এইসব অপকর্ম একদিকে যেমন ব্যক্তির আত্মাকে কলুষিত করছে, তেমনি সমাজকে করছে নৈতিকভাবে দুর্বল। এর ফলে দেখা যায় মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস কমে যাচ্ছে, পারস্পরিক বিশ্বাস হারিয়ে যাচ্ছে, পরিবারে অশান্তি তৈরি হচ্ছে এবং সন্তানেরা বিপথে চলে যাচ্ছে। হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে শ্রম পরিশ্রমকে। একজন কৃষক যখন নিজের ঘামে ভিজে ফসল ফলায়, একজন দোকানি যখন সততার সঙ্গে পণ্য বিক্রি করে, কিংবা একজন চাকুরিজীবী যখন সময়মতো অফিসে যায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করেতখন তা হালাল রিজিকের অন্তর্ভুক্ত হয়। এইসব হালাল পথে উপার্জনকারী ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (সা.) খুব সম্মানের দৃষ্টিতে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, “নিজের হাতে উপার্জিত খাবারের চেয়ে উত্তম কিছু নেই। (বুখারী)

হালাল রিজিকের প্রভাব শুধু পার্থিব জীবনে নয়, বরং আখিরাতেও পরিলক্ষিত হবে। পবিত্র হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি হালাল উপার্জন করে, তার দান কবুল হয়, দোয়া কবুল হয় এবং সে জান্নাতে যাবে। এর বিপরীতে হারাম উপার্জনকারী ব্যক্তির আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। এই জায়গাটিতে এসে হালাল রিজিকের গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একজন মুমিন যদি তার ইবাদত, দোয়া দানকে কবুল করাতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই হালাল উপার্জনের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। হালাল রিজিকের আরেকটি দিক হলো জীবনের নিরাপত্তা প্রশান্তি। হালাল উপার্জন ব্যক্তি, পরিবার সমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে। একজন হালাল উপার্জনকারী সহজেই সন্তুষ্ট থাকতে শিখে, অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ জন্মায় না এবং সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠে। অন্যদিকে, হারাম উপার্জন মানুষকে অপরাধে টেনে নিয়ে যায়, অবৈধ পথে চালিত করে এবং সর্বোপরি আল্লাহর গজব লানতের কারণ হয়। অন্যদিকে, হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, কষ্ট ত্যাগের মানসিকতা। অনেক সময় হালাল পথে উপার্জন করা কঠিন মনে হয়, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে বরকতপূর্ণ কল্যাণকর। মহান আল্লাহ নিজেই হালাল রিজিকের বরকতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। হাদিসে এসেছে, “যে ব্যক্তি হালাল রিজিক উপার্জনের জন্য চেষ্টা করে, সে আল্লাহর পথে মুজাহিদের মতো।

আজকের প্রজন্মের জন্য এই বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারনেট, অনলাইন বিজনেস, ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যাটফর্ম এসবের মাধ্যমে দ্রুত অর্থ উপার্জনের নামে অনেকেই হারামের পথে পা রাখছে। মুসলিম যুবকদের উচিত এই ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচানো এবং হালাল-হারামের জ্ঞান অর্জন করা। কারণ, হালাল রিজিকই একজন মুসলিমের চরিত্র গঠনের মূল ভিত্তি।

সুতরাং, হালাল রিজিক কেবল খাওয়া বা অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এটি ঈমান, ইবাদত, দোয়া, পরিবার, সমাজ এবং আখিরাতের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। একজন মুসলমান হিসেবে আমাদের উচিত, যেকোনো মূল্যে হালাল পথে রিজিক উপার্জনের চেষ্টা করা এবং হারাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বেঁচে থাকা। এর মাধ্যমেই আল্লাহর রহমত লাভ হবে, জীবনে প্রশান্তি আসবে এবং পরকালের মুক্তি অর্জিত হবে

 

Post a Comment

Previous Post Next Post